করোনা আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তারা করোনামুক্ত হলেও এর থেকে মুক্তি নেই সহজে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর শুরু হয় ‘লং কোভিড’ নামক অসুখ। এর প্রভাব হয়তো সারাটা জীবন তাদের বয়ে বেড়াতে হবে শারীরিক ও মানসিক নানা ধরনের জটিল সমস্যা। শ্বাসতন্ত্র, রক্ত সংবহনতন্ত্র, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, স্মৃতিশক্তি, মেধা, মনোজগৎ, ঘুমের স্বাভাবিকতা, পরিশ্রমের ক্ষমতা, প্রজননতন্ত্র, যৌনতাসহ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই লং কোভিড এখন বিজ্ঞানীদের মহাচিন্তিত করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কালো, সাদা ও হলুদ ছত্রাক আক্রান্তের ঝুঁকি। কারোনা আক্রান্ত হয়ে লাইফ-সাপোর্টে থাকা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেরে ওঠার পর শুরু হবে ‘লং কোভিড’-এর নানা জটিলতা। কিছু শিক্ষার্থী হয়তো আর কোনও দিন ক্লাসেই ফিরবেন না। নানা তথ্যে দেখা যাচ্ছে অনেকের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণেও হয়তো কারও কারও ফেরা হবে না। দীর্ঘদিন শিক্ষার সংস্পর্শে না থাকার কারণে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহে মারাত্মক ভাটা পড়েছে। প্রায় কর্মহীন দীর্ঘ অবসরে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিতে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। পাল্টে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। রাত জেগে গেমস খেলছে, মুভি দেখছে ও দিনের বেলায় ঘুমোচ্ছে। নামমাত্র অনলাইন ক্লাসে যোগদান করছে। এমনকি ক্লাসে যোগ দিয়ে গেমস খেলছে কিংবা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকছে। এছাড়াও মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ঘুম কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় ভুগছে তারা।
সম্প্রতি ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এই ১৩টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আছে একমাত্র বাংলাদেশ। এসব দেশে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের ক্ষতি সহজেই দৃশ্যমান। কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নয়। ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে এর ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব। বিভিন্ন গবেষণায় শিক্ষায় ক্ষতির যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা গভীর উদ্বেগজনক। শিক্ষার জন্য তা ভয়ংকর অশনি সংকেত। টানেলের অপর প্রান্তে একটুখানি আলোর রেখার দেখা মিললেও সেই সঙ্গে শঙ্কাও রয়েছে।
আগামী ১৩ জুন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে অনেক ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ রয়েছে। করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না এলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে মত নেই কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির। শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর পরিস্থিতি খারাপ হলে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হবে না। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে, সীমান্তবর্তী রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের ওপরে। ফলে ১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
গত ১০ মে প্রকাশিত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ জরিপে দেখা যায়, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ৯৭ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত না খুললে রাজপথ অচল করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কারও আন্দোলনের তোপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার চাইতে বন্ধ রাখতেই আমরা বেশি এসএমএস পাচ্ছি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সুরক্ষার জন্য বন্ধ রাখতে এসএমএস করে জানাচ্ছেন। কিছু মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আন্দোলনের কথা বলছে। অধিকাংশ মানুষ তার বিপরীতে কথা বলছেন। তাই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। টিকা দেওয়া শেষ হলে করোনা পরিস্থিতি দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার টিকাদান শুরু হলে গত ৪ মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে টিকা দিতে আরও কয়েক মাস দরকার হবে। ১৫ মাস পরও তাই ভীষণ অনিশ্চয়তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলাকে কেন্দ্র করে।
অনেকের প্রশ্ন, করোনা থেকে কবে আমরা মুক্ত হবো, তা বলা যাচ্ছে না। তাহলে কতদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যাবে? তাদের প্রশ্ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া ছাড়া অন্য সব কাজই করছে। শিক্ষার্থীরা এখন আর ঘরে বসে নেই। শিক্ষার্থীদের পদচারণা বাজার, রেস্তোরাঁ, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, দলবেঁধে আড্ডা, দেশে-বিদেশে পর্যটন স্পটসহ সব জায়গায়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রেই করোনার ভয় কেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সবকিছু খোলা। শিক্ষার্থীরাও ঘরে বসে নেই। তাহলে কোন যুক্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে?
আগামী ১৩ জুন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল থাকুক। প্রয়োজনে অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি ৭-১০ দিন পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। আর বিলম্ব নয়, কোনও কারণেই। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেই হবে না, দেড় বছরের ক্ষতি পোষানোর পরিকল্পনা নিতে হবে সেই সঙ্গে। শিক্ষাজীবন বিলম্বিত হওয়ায় কিছু দিনের জন্য হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। করোনা জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষার ওপরে যে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে, আমরা যেন সেই মৃত্যু পরোয়ানাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকরণে রূপ না দেই। শিক্ষার মৃত্যু মানে তো একটি জাতির মৃত্যু।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com