এখন প্রশ্ন হলো, এই যে নারীর ওপর সহিংসতার এই বহুবিধ উপায় তৈরি হচ্ছে, এর পেছনে আসলে সমাজের কী কী মনস্কতা কাজ করে। প্রথমত, লিঙ্গীয় রাজনীতির অসম ক্ষমতা সম্পর্ক, যা একভাবে নারী নিপীড়নকে যেমন বৈধতা দেয়, অন্যদিকে সেই একই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চা জারি রাখার জন্য এ ধরনের নারী নিপীড়নের নতুন নতুন সহিংসতার রূপ হাজির হওয়াকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে প্রশ্নহীনভাবে হাজির করায়।
মজার বিষয় হলো, মা দিবসে মাকে যতই ভালোবেসে সবাই ছবি পোস্ট করে মায়ের স্তুতি গাই না কেন স্পষ্টতই নারীকে দেখার ক্ষেত্রে এর বৈপরীত্য লক্ষণীয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে এক ধরনের মিসোজিনি দেখা যায়, অর্থাৎ সমাজে নারীকে ঘৃণা করার যে রাজনীতি সেটি আমরা নানাভাবে দেখতে পাই। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারীকে হেয় করে নানা ধরনের কৌতুক, মিম এবং এর পাশাপাশি নারীকে হেয় করা ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অনেকটাই প্রশ্নহীনভাবেই নারীর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের কৌতুক বা মিম লোকজন ‘ফান’ বা ‘মজা’ হিসেবেই দেখে এবং ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়ে শেয়ার করতে থাকে। এ বিষয়ে কোনও ধরনের প্রশ্ন করাকে ‘আপনার কি কোনও সেন্স অব হিউমার নেই’ জাতীয় কথাবার্তা বলে থামিয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবাদের বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সমস্যাগুলো নানামুখী। এখন পর্যন্ত এ দেশে ধরেই নেওয়া হয় যে নারীর প্রতি সহিংসতা শুধুই নারী ইস্যু, নারীরাই এগিয়ে গিয়ে এর প্রতিবাদ জানাবে। আরও মজার বিষয় হলো, আবার নারীর সহিংসতার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তাদের নারীবাদী তকমা দিয়ে আলাদা করা হয় সেক্ষেত্রেও ভয়াবহ ঘৃণা কাজ করে। বলে রাখা প্রয়োজন যে এই নারীবাদ সম্পর্কে সমাজের জেঁকে থাকা ভ্রান্ত ধারণাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেসব পুরুষ নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে ‘উনিতো আবার নারীবাদী’ বলে হয়রানি করা হয়।
আইনের বাইরে বা পাশাপাশি এ ধরনের সহিংসতার ধরনগুলো মোকাবিলার মতো আসলে খোলা আছে কতখানি? এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে ফেসবুকীয় টেক্সট, যা এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি সমাজে সব ধরনের লিঙ্গীয় সমতা আনার ক্ষেত্রে বড়সড় ভূমিকা রাখতে পারে। ইতোমধ্যে অবশ্য তা শুরু হয়েছে কিছুটা। ফেসবুকীয় জোক, মিম এগুলো যে কোনোভাবেই নিরীহ কিছু নয়; বরং লিঙ্গীয় সম্পর্কের পুনরুৎপাদন এবং লিঙ্গীয় ক্ষমতাচর্চারই রূপ। তাই এগুলোর রাজনৈতিক মোকাবিলাও জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখানে আনতে চাই। তা হলো, প্রতিবাদ ক্ষেত্রে আমাদের ভাষা। সেদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ইশরাত জাহান ঊর্মির একটি শোতে আমি আর বন্যা মির্জা ছিলাম অতিথি। সেখানে বন্যা মির্জা খুবই মজার একটি বিষয় উত্থাপন করেন, আর সেটি ছিল আমরা কীভাবে প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ‘নিজ-অপরের’ রাজনীতি করি। দেখা যায় যে কোনও নারীর ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বোন হিসেবে নিয়েই তার বিচার চাই, মিছিল থেকে প্রায়ই শোনা যায়, ‘আমার বোন ধর্ষিত কেন? কিংবা আমার বোন নিপীড়নের শিকার কেন?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বন্যা করতে পেরেছিলেন, তা হলো কেন কারও নিপীড়নের বিষয়ে আমাদের প্রতিবাদ করতে হলে তাদের বোন হিসেবেই করতে হবে। সে আমার অপরিচিত, তাই বলে কি আমরা তার ওপর করা নিপীড়নের প্রতিবাদ করবো না?
আসলে এই যে জ্ঞাতি সম্পর্কের মধ্যে নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিকে ফেলে আমরা প্রতিবাদের জায়গাগুলো করি সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। আমার বোন না বানিয়েও একটা নিপীড়নের প্রতিবাদ করা সম্ভব। কারণ, আমরা ‘নিজ-অপর’ এই পার্থক্য ঘুচাতে চাই না। অন্যদিকে সমাজে আদৃত সম্পর্কগুলোর মধ্যে মা এবং বোন এগুলো নিয়ে ‘ডি সেক্সুয়ালাইজড’ একটা মিথ আছে, যার কারণে রাস্তাঘাটে একজন আপনার গায়ে হাত দিলে আপনি কঠোরভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে, ‘হঠাৎ করে শুনতে পাবেন, আমাদের তো মা -বোন আছে’। তখন আপনি চুপসে যাবেন?
এ ধরনের চর্চিত সাম্পর্কিক মিথগুলোকে ভাঙা খুই জরুরি।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com