এর আগে ভারতেরই অন্য একদল কিশোরের তামিল অ্যাকশন মুভির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদেরও প্রশংসা করেছেন অনেকে। সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ‘এক হাত’ নিয়েছেন কেউ কেউ। বীরদর্পে বলেছেন, বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতাদের উচিত এই কিশোরদের কাছ থেকে কিছু শিখে নেওয়া। যারা এ ধরনের মন্তব্য করেছেন তারা কতটুকু বুঝে মন্তব্য করেছেন জানি না। আমার ধারণা তারা ভুল মন্তব্য করেছেন।
শিশুরা ফিল্ম বানাবে। তাদের কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে। এটা আমিও চাই। তাই বলে তারা খুন, জখম, রাহাজানি, মারামারি ধর্ষণকেই তাদের ফিল্মের বিষয় করে তুলবে? তাহলে দেশের পাড়া মহল্লায় এই যে এত কিশোর গ্যাং মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, কেউ কেউ অশ্লীল অশোভন ‘টিকটক’ বানাচ্ছে তাদেরকে আমরা ক্ষতিকর ভাবছি কেন? ওরাও তো অনেকটাই তামিল মুভির অনুসারী। আলোচিত কিশোরদের বানানো তথাকথিত মুভিতে অ্যাকশন অর্থাৎ ভয়-ভীতি দেখানোই মূল উদ্দেশ্য। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও ভয়-ভীতি দেখায়। তাহলে মুভি বানিয়ে ভয় দেখানো গেলে মুভির শিক্ষা নিয়ে ভয় দেখাতে দোষ কোথায়?
আবারও সেই কথাটিই উল্লেখ করতে চাই। যার কাজ তারই সাজে...। ছোটদের উচিত নয় বড়দের মতো করে আচরণ করা, বড়দের মতো করে অন্যকে শাসন করা। অথচ আমরা বুঝে না বুঝে শিশু-কিশোরদের অনেক অন্যায়-অশোভন আচরণ ও উদ্যোগকে সমর্থন জানাচ্ছি। বলছি, আহা! বেশ বেশ... তবে এই ক্ষেত্রে শিশু-কিশোররাই যে এককভাবে দায়ী তা কিন্তু নয়।
করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। মাঝে মাঝে অফিস আদালত খুলে দেওয়া হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র খোলা ছিল। দেশের যাতায়াত ব্যবস্থাও বিধি-নিষেধ এক সময় তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অলসতা ভর করেছে। আমরা মানি বা না মানি এই মুহূর্তে কিশোর-তরুণদের সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যমই হলো ফেসবুক সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একটি মোবাইল ফোন হাতে থাকলেই গোটা পৃথিবীর আলো অন্ধকার, ভালো-মন্দ সব কিছুই নাগালের মধ্যে চলে আসে। অনেকে ফেসবুকেই খায়, ফেসবুকেই ঘুমায়। ফেসবুকে যা দেখে তাই ফলো করার চেষ্টা করে। আর তাই করোনাকালীন এই দুঃসময়ে কিশোর-তরুণেরা ফেসবুক সহ সামাজিক সকল যোগাযোগ মাধ্যমের দাসে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম যে শুধু খারাপই শেখায় তা তো নয়। ভালোও শেখায়। কিন্তু ভালোর চেয়ে খারাপই আকর্ষণ ছড়ায় বেশি। সেজন্য কিশোর তরুণেরা খারাপ অর্থাৎ অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তাদেরকে ভালো আর আলোর পথে আনার সমন্বিত কোনও উদ্যোগ নেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাফল্য অর্থাৎ ভালোর কাজের ভিডিও তেমন একটা লাইক পায় না। কিন্তু মন্দ কাজের ভিডিও সমানে লাইক পায়। সেজন্য মন্দ কাজের প্রতিই অনেকের আগ্রহ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু পথযাত্রীকে তাৎক্ষনিকভাবে হাসপাতালে নিলে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু সেটা না করে অনেকে তার মৃত্যুর ছবি তোলার জন্য সীমাহীন কসরত শুরু করে দেন। এর একটাই কারণ ‘ভিউ’ বাড়ানো! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ভিউ’ বাড়ানোর নেশায় নাটক সিনেমা বানানোর নামেও অনেকে যৌনতাকেই বেশি করে উসকে দিচ্ছেন। আমাদের পাশের দেশের অনেক নির্মাতা এক্ষেত্রে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। যৌনতাকে পুঁজি করে নাটক, সিনেমা বানিয়ে ফেসবুকে তার উত্তেজক অংশ ছেড়ে দিচ্ছেন। তাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অনেকে।
গত কয়েকদিনে ফেসবুকে নাটক সিনেমার হাই লাইটস প্রচারের নামে এমন কিছু দৃশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, চূড়ান্ত ধরনের অশ্লীলও বটে। ৫/৭ মিনিটের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ। অশ্লীল শব্দ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, যৌনতায় ভরা এই সব ভিডিও ক্লিপের দর্শকও প্রচুর। করোনার এই জটিল সময়ে বিনোদনে মেটানোর নামে এইসব অরুচিকর দৃশ্য গোগ্রাসে গিলছে এক শ্রেণির দর্শক। যাদের মধ্যে কিশোর ও তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
ফেসবুকে ‘ভিউ’ বাড়লেই নাকি টাকা বাড়ে। আর তাই নারীর শরীর দেখানো নাটক, সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়েছে পাশের দেশে, কলকাতা সহ অন্যান্য শহরে। তাই দেখে আমাদের দেশেও এক শ্রেণির নির্মাতা ও অভিনেতা-অভিনেত্রী তথাকথিত ‘সাহস’ প্রদর্শনের নামে শরীর খোলা শর্ট দিচ্ছে। এজন্য বাহাবাও পাচ্ছে।
কিছুদিন আগে একজন নির্মাতা আমার কাছে একটা গল্প চাইলেন। গল্পটির সারাংশ তাকে বললাম। তেমন একটা উৎসাহ দেখালেন না। বললেন, সময় বুঝে গল্প লেখেন। এই যেমন পরকীয়া, সংসারের ভাঙন, যৌনতা এসব না থাকলে দর্শক এখন সিনেমা, টিভি নাটক ‘খায়’ না।
সিনেমা টিভি নাটক কি তাহলে এখন দেখার চেয়ে ‘খাওয়া’র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে? তাহলে তো ওই কিশোরদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের মুভি বেশ ‘খাচ্ছে’ তথাকথিত দর্শক। আহা! বেশ বেশ...
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।