মডেল মানেই কি রাতের রানি?

রেজানুর রহমানকে মডেল? কে অভিনেতা, অভিনেত্রী, কে শিল্পী? এই পরিচয়ের বোধকরি একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা প্রয়োজন। কোন যোগ্যতায় কাকে কখন শিল্পী বলা যাবে, কে মডেল হয়ে উঠবেন, কাকে নাট্যকার অথবা পরিচালক বলবো এরও একটা গাইডলাইন জরুরি। প্রতারণার দায়ে পিয়াসা ও মৌ নামে দু’জন নারী গ্রেফতার হয়েছেন। প্রচারমাধ্যমে তাদের অভিনেত্রী ও মডেল হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এর ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নারী কর্মীদের নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন যে অভিনেত্রী অথবা মডেল মানেই অন্ধকারের মানুষ। নানা উপায়ে ধনাঢ্য পুরুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ আয় করাই তাদের মূল কাজ। অথচ এটি প্রকৃত সত্য নয়। প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার হওয়া দুই নারী আদতে অভিনেত্রী অথবা মডেল নন।

ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি বিশিষ্ট অভিনেতা, পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু স্বয়ং বলেছেন, আলোচিত দুই নারী পিয়াসা ও মৌকে তিনি চেনেন না। তারা আমাদের নাটক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্রিয়াশীল কোনও সংগঠনের সদস্যও নন। হতে পারে দুই একটি নাটক অথবা বিজ্ঞাপনে তারা মুখ দেখিয়েছেন। এটাই মডেল হওয়ার যোগ্যতা নয়। অথচ প্রচার মাধ্যমে বেশ গুরুত্ব সহকারে তাদের অভিনেত্রী ও মডেল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত অর্থে যারা শিল্পী, মডেল হিসেবে খ্যাত তারা প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। এর একটি বিহিত হওয়া প্রয়োজন।

এখন প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কে মডেল, কে মডেল না এটাই বা নির্ধারণ করবে কে? তবে এক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমের একটা দায় আছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। মিডিয়ায় পরিচয় তুলে ধরার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া আবশ্যক। ধরা যাক, ধর্ষণের অভিযোগে একজন যুবককে গ্রেফতার করা হলো। প্রচার মাধ্যমে খবর প্রকাশ হলো- ধর্ষণের দায়ে শিক্ষক গ্রেফতার। অথচ অভিযুক্ত যুবক কোনোদিন স্কুল অথবা কলেজে শিক্ষকতা করেননি। তবে দুই এক মাস হয়তো কোনও ছাত্র অথবা ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। এজন্য তাকে কি শিক্ষক বলা যাবে? অথচ তাকে শিক্ষক হিসেবেই পরিচয় করানো হলো। এর ফলে সমগ্র শিক্ষক সমাজ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অথচ অভিযুক্ত যুবক তো শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি নয়।

ঠিক একই ধরনের কলঙ্ক নিতে হচ্ছে দেশের শোবিজ অঙ্গনকে। দুই একটি নাটক, সিনেমায় ‘পাসিং শট’ দিয়েও অনেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে নিজেদের ফোকাস করছেন। এ তালিকায় মেয়েরাই আছে এগিয়ে। গ্রেফতার হওয়া দুই নারী পিয়াসা ও মৌ আদতে আমাদের নাটক, মডেলিং পরিবারের সক্রিয় কোনও সদস্য নয়। অথচ প্রচার মাধ্যমসমূহে তাদের নামের আগে মডেল ও অভিনেত্রীর বিশেষণ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।

একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের খবর তুলে ধরতে চাই। খবরের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- ‘মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের টার্গেট ছিল কোটিপতির সন্তানরা।’ খবরের বর্ণনা এরকম- মডেল ও উপস্থাপিকা ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মডেল মৌ আক্তারকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। আলাদা অভিযানে তাদের দুই জনের বাসা থেকে মদ ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ বলছে, পার্টিতে ধনাঢ্য ব্যক্তি অথবা তাদের সন্তানদের ডেকে এনে কৌশলে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতো তারা। দুই মডেলই এক চক্রের সদস্য বলে দাবি পুলিশের। ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর-রশিদ প্রচার মাধ্যমে পিয়াসা ও মৌকে ‘রাতের রানি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এরা দিনের বেলা ঘুমায়। রাতের বেলায় বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে পার্টির আয়োজন করে। এই পার্টিগুলোতে তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তাদের সন্তানদের আমন্ত্রণ জানায় এবং পার্টি চলাকালে কৌশলে তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করার ফাঁদ পাতে। সম্মান বাঁচাতে ধনাঢ্য ব্যক্তি অথবা তাদের সন্তানেরা টাকার বিনিময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।

পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি অন্ধকার জগতের রহস্য উদঘাটনের জন্য। কিন্তু এরা তো প্রকৃত অর্থে শিল্পী না। কিন্তু শিল্পী হিসেবেই তাদের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে। পুলিশের সম্মানিত যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর-রশীদ গ্রেফতারকৃত দুই নারীকে ‘রাতের রানি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অভিযুক্ত দুই নারীর অপরাধ, অপকর্ম বোঝাতে হারুন-অর-রশীদের উপমা যথার্থ। কিন্তু তার এই উপমা এক অর্থে দেশের নিবেদিতপ্রাণ মডেল ও শিল্পীর পরিচয় ও ত্যাগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়েছে।

মডেল পিয়াসা ও মৌ যদি ‘রাতের রানি’ হয় তাহলে মডেল মানেই রাতের রানি, এমন নেতিবাচক ধারণাও ছড়িয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।

তথাকথিত মডেল পরিচয়ধারী পিয়াসা ও মৌয়ের অন্ধকার জগতের খবর এখন সবার মুখে মুখে। আমাদের দেশে সাধারণত কোনও একটি ঘটনা প্রকাশ পেলেই সংশ্লিষ্ট দফতর, প্রতিষ্ঠানসহ সাধারণ মানুষও ওই ঘটনার পেছনে দৌড়াতে শুরু করে। এমন প্রতিটি ঘটনার পরই একটা প্রশ্নই দেখা দেয়। তা হলো, আগে কেন জানা গেলো না। প্রচার মাধ্যমেই খবর বেরিয়েছে, পিয়াসার অধীনে নাকি শতাধিক সুন্দরী তরুণী আছে। তাদের দিয়েই ধনীর দুলালদের নিজের ফাঁদে ফেলতেন পিয়াসা। বারিধারায় অভিজাত ফ্ল্যাটে বসবাস করেন, কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। তথাকথিত একজন মডেল অথবা অভিনেত্রীর পক্ষে এত জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করা কি আদৌ সম্ভব? অন্যদিকে মৌ’য়ের পরিচয় ‘লেডি মাফিয়া গ্যাং লিডার’ হিসেবে। ঢাকা শহরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে তার। যে চক্রের সদস্যদের প্রত্যেকেই নারী। চক্রটি নাকি ‘লেডি মাফিয়া গ্যাং’ নামে পরিচিত। প্রশ্ন হলো, এত নারী একসঙ্গে এই যে অন্ধকার জগৎ পরিচালনা করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি এতদিন কিছুই জানতো না? শোবিজকে এরা পরিচয়ের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদের শোবিজ অর্থাৎ নাটক, সিনেমা, সংগীত ও মডেলিংয়ের বিভিন্ন সংগঠন আছে। সংগঠনগুলোরও কি উচিত ছিল না এ ব্যাপারে আগাম তৎপর থাকা? কী দুর্ভাগ্য আমাদের। ‘লেডি মাফিয়া গ্যাং লিডার’ হিসেবে যার পরিচিতি তাকেই আমরা ‘মডেল’ আখ্যা দিচ্ছি। তার মানে সব মডেলই এমন অন্ধকার জগতের মানুষ। এমন বার্তাই তো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

এর প্রতিকার কী? প্রতিকার হলো একটাই- আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্রিয়াশীল প্রতিটি সংগঠনের সোচ্চার ভূমিকা। পিয়াসা ও মৌর মতো অনৈতিক চরিত্রের অধিকারীরা যেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঢুকতে না পারে। মিউজিক ভিডিও, টিকটক ভিডিও ও নাটক নির্মাণের নামে অনেক পরিচালক, প্রযোজক অশ্লীলতাকেই পুঁজি হিসেবে বেছে নিয়েছে। এদের কেউ কেউ নাকি ডিরেক্টরস গিল্ড, প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য। যদি তাই হয় তাহলে তো মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। একজন পিয়াসা, একজন মৌ তো গ্রেফতার হলো। তাদের অনুসারীরা তো আছে। ভবিষ্যতে এদের মধ্য থেকে আবারও যে কেউ শোবিজকে ব্যবহার করে পিয়াসা অথবা মৌ হিসেবে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে না তার নিশ্চয়তা কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার; সম্পাদক- আনন্দ আলো।