আসাম-মিজোরামের অস্বাভাবিক ‘যুদ্ধ’

আনিস আলমগীরবাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যে এমন পরিস্থিতি চলছে যেন এক দেশের দুটি রাজ্য নয়, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই দুই রাজ্যের বিরোধটা এমন মাত্রায় গেছে যে এক রাজ্যের নাগরিক আরেক রাজ্যে না যাওয়ার জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কোনও নিষেধাজ্ঞা নয়, আসাম রাজ্য তার নাগরিকদের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পার্শ্ববর্তী মিজোরাম রাজ্যে না যাওয়ার জন্য। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানে আসামের জনগণের জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা আছে।

শুধু তা-ই নয়, আসাম সরকার মিজোরাম থেকে যেসব গাড়ি আসামে আসছে তা চেক করার নির্দেশনা দিয়েছে। কারণ হিসেবে বলছে, অবৈধ ড্রাগ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা হিসেবে তারা এটি জারি করেছে, যা পর্যবেক্ষকরা বলছে হাস্যকর। এখানে শেষ নয়, মিজোরাম এবং আসামের মধ্যে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করার কথাও আলোচিত হচ্ছে। এই সুযোগে দুই রাজ্যের এমপিরা একে অন্যকে হুমকি দিচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে বাগযুদ্ধ, সেই সঙ্গে হিন্দু-খ্রিষ্টান সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প।

মিজোরামের প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। আর কেন্দ্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক আসামের মধ্য দিয়ে দুটি সড়ক। অর্থাৎ মূল ভূখণ্ডে যেতে হলে তাকে আসামের ওপর দিয়ে যেতে হবে। দু’ সড়কই তাদের লাইফ লাইন।

ভারতের এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের গণ্ডগোল নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে পানি নিয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে গণ্ডগোল দীর্ঘদিন থেকে চলমান ছিল। কিন্তু আসাম ও মিজোরামের যুদ্ধাবস্থার খবর দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশি মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে এই পর্যায়ের গণ্ডগোল ভারতবাসী কখনও চোখে দেখেনি। মিজোরামের পুলিশ আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে দুই রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায়।

ঘটনার শুরু হয়েছিল গত ২৬ জুলাই ২০২১, আসামের সীমান্তবর্তী কাছাড় জেলার এক গ্রামের সঙ্গে মিজোরামের সীমান্তবর্তী কোলাসিব জেলার এক গ্রামের লোকদের সংঘর্ষে দুই রাজ্যের পুলিশ জড়িত হয়ে গেলে। দুই রাজ্যের পুলিশের মধ্যে ক্রসফায়ারে সাত জন নিহত এবং ৬০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছয় জনই আসামের পুলিশ সদস্য।

আসাম সরকার বলছে, মিজোরাম সেখানে রোড কনস্ট্রাকশন করছে, যা আসামের রিজার্ভ ফরেস্টের জন্য হুমকি। আসামের পুলিশ সেখানে গিয়েছিল পরিস্থিতি থামাতে আর মিজোরাম পুলিশ এমন উত্তেজনা তৈরি করেছে যে তাতে ঘটনা আরও খারাপের দিকে গেছে। অন্যদিকে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, প্রথম গুলি আসামের পুলিশ করেছে এবং আত্মরক্ষার্থে মিজোরাম পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে দুই রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন। আসামের বিজেপির এক এমপি বলেছেন, যদি আসাম মিজোরামের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে রাখে তবে মিজোরামের সরকার, পুলিশ, জনগণ সবাই না খেয়ে মারা যাবে। অন্যদিকে মিজোরামের এক এমপি বলেছেন, আসাম পুলিশের লোকেরা খুব ভাগ্যবান যে তাদের সবাই মারা পড়েনি। যদি আবার আসে সবগুলোকে শেষ করে দেওয়া হবে।

মিজোরাম অবশ্য এরইমধ্যে দাবি করেছে যে আসাম তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছে। কারণ, আসাম থেকে মিজোরামে কোনও যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আসাম থেকে আসা পণ্য সরবরাহের ওপরই মিজোরাম নির্ভর করে। ব্রিটিশ আমলে মিজোরাম পরিচিত ছিল লুসাই পাহাড় নামে, ছিল আসামের অংশ। ১৯৭২ সালে এটি একটি কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে আলাদা হয়ে যায়। পরে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী এমএনএফ-এর মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে মিজোরাম রাজ্যের মর্যাদা পায়।

অবরোধের ঘটনায় মিজোরাম আসাম সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের কাছে বিচার দিয়েছে। যদিও আসাম তা অস্বীকার করেছে। আসামের জনসংখ্যা তিন কোটি। ১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর পাহাড়ি রাজ্য মিজোরামের বিরুদ্ধে আসামের অবরোধ জারি অবশ্য নতুন নয়। গত বছরও এমন এক ঘটনায় টানা ২৫ দিন অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে রেখেছিল আসাম।

মিজোরামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্ট লালথাংলিয়ানা বলেছেন, ‘যুদ্ধে দুই পক্ষের বাহিনী লড়াই করলেও ওই সময় চিকিৎসা সামগ্রী এবং আহত ব্যক্তিদের চলাচলে কোনও বাধা দেওয়া হয় না। আসামের এই অবরোধ অমানবিক।’

আশ্চর্যজনক হচ্ছে যে আসামে সরকার রয়েছে বিজেপির। অন্যদিকে মিজোরামেও রয়েছে বিজেপি জোটের সরকার। স্থানীয় মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) মিজোরাম শাসন করছে এবং তারা বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র একটি অংশ। আর ঘটনার মাত্র দুই দিন আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ভ্রমণ করেছেন এবং সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এক বৈঠকে রাজ্যগুলোকে একের সঙ্গে অন্যের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

লক্ষণীয় যে, আগের ঘটনাগুলোতে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে গণ্ডগোল ছিল। এখন শুধু দুই এলাকার লোকদের মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে না। এখন দুই সরকারের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে। এটাই আতঙ্কের বিষয়।

মিজোরামের ৮৭ ভাগ লোক খ্রিষ্টান। আর আসামে ৬০ ভাগ হিন্দু, ৪০ ভাগ মুসলমানের বসবাস। আসামের ২৭ জেলার ১৮টিতে হিন্দু মেজরিটি এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা সেখানে এমন মাথাছাড়া দিয়েছে যে সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশি বানিয়ে ঠেলে পাঠানোর প্রচারণায় আছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও। ধর্ম খ্রিষ্টান বলে মিজোরামের লোকদের বাংলাদেশি তকমা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই; কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই রাজ্যের জনগোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচুর হিংসা ছড়াচ্ছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত দুই রাজ্যের প্রধানদের ডেকে এক টেবিলে বসে এর সমাধান করে দেওয়া। কেউ কেউ বাউন্ডারি কমিশন গঠন করে সীমান্ত সমস্যা কাটিয়ে ওঠারও পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে সেটি কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। আসামের সঙ্গে নাগাল্যান্ডেরও বর্ডার নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ১৯৮৫ সালে নাগাল্যান্ডের শহর মেরাপানীতে আসাম এবং নাগাল্যান্ড পুলিশের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে আসামের পুলিশসহ ৪১ জন নিহত হন। তখন শাস্ত্রী কমিশন গঠন করা হয়েছিল সমস্যা সমাধানে। কিন্তু কমিশনের রিপোর্ট দুই রাজ্যের কেউই মেনে নেয়নি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com