ডু নট টাচ মাই ক্লথস: আমাদের জন্য কেন জরুরি?

জোবাইদা নাসরীনআফগানিস্তানের নারীদের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ দেখছে বিশ্ব। সংখ্যায় হয়তো বেশি নয়, কিন্তু তালেবানদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তারা সামাজিকমাধ্যম এবং রাজপথে  সরব রয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে আফগানিস্তানে তালেবানরা যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করেছে সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় নেই কোনও নারী। শুধু এটি করেই ক্ষান্ত হয়নি তালেবানরা, দেশটির নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের সাইনবোর্ড বদলে ফেলে সেখানে পাপ ও পুণ্য মন্ত্রণালয়ের নামে নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সেখানে দারি ও আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে, প্রার্থনা, নির্দেশনা এবং পুণ্যের প্রচার ও পাপ ঠেকানো মন্ত্রণালয় (বাংলা ট্রিবিউন , ১৭ সেপ্টেম্বর)।  

এমনকি মন্ত্রণালয়ের ভবনেও কোনও নারীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন আফগান নারীরা। এর আগে নারীদের ফুটবল খেলা, নারীদের উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তারা। তালেবানেরা প্রথম যে বিষয়টির ওপর চাপ তৈরি করেছে তা হলো নারীর পোশাকের স্বাধীনতার ওপর। দেখা গেছে, রাতারাতি  দেশটির নারীরা কালো কিংবা নীল বোরকা পরে চলাচল করছে এবং তালেবানদের পক্ষে মিছিল এবং র‍্যালিতে অংশ নিচ্ছে।
 
তালেবান সরকারের এই নারীবিদ্বেষী অবস্থান এবং সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আফগানিস্তানে বুল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ বাদাখশানে কয়েক ডজন নারী রাস্তায় নেমে তালেবানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। দেশটির রাজধানী কাবুল ও বাদাখশান, পারওয়ান ও নিমরুজ  প্রদেশে এই বিক্ষোভ হয়েছে। এই বিক্ষোভ অন্যান্য বিক্ষোভের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ  এ কারণেই যে আফগানিস্তানে নতুন সরকারের ঘোষণা দেওয়া নারীদের ঘরে থাকা এবং অন্যান্য বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার মুখেও নিজেদের অধিকার আদায়ে বিক্ষোভ জারি রেখেছেন দেশটির নারীরা। শুধু বিক্ষোভই নয়, তারা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, যে সরকারে কোনও নারী নেতৃত্ব নেই এমন সরকার তারা কোনোভাবেই গ্রহণ করবেন না। নারীকে বাদ দিয়ে তালেবানদের সরকার গঠন এবং একের পর এক নারীবিরোধী সিদ্ধান্তে  ক্ষোভ প্রকাশ করছে বিশ্বনেতৃবৃন্দও।

বিক্ষোভ যে শুধু রাজপথেই চলমান রয়েছে তা নয়, এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। নারীর পোশাক পরিবর্তনের জন্য তালেবানদের চাপের বিষয়ে ফেসবুকে একটি আন্দোলন চলেছে, আর সেই আন্দোলনের স্লোগান হলো’ #Do NotTouch My Clothes এবং #Afghanistan Culture. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনকে সামনে নিয়ে আসেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক ড. বাহার জালালি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনের গুরুত্ব নিয়ে তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আফগানিস্তানের পরিচয় এবং সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে বলে তার মনে হয়েছে, এটা নিয়ে তিনি সবচেয়ে উদ্বিগ্ন। সে কারণেই তিনি এই আন্দোলন শুরু করেছেন। এই প্রতিবাদী হ্যাশট্যাগ ফেসবুকে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং হ্যাশট্যাগের প্রতিবাদে অনেকে অনলাইনে তাদের বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী পোশাক শেয়ার করছেন। তাতে যোগ দেন আরও অনেকে। তিনি নিজে একটি সবুজ আফগান পোশাক পরে একটি ছবি টুইটারে পোস্ট করেন এবং এর পাশাপাশি তিনি অন্য আফগান নারীদেরকেও ‘আফগানিস্তানের আসল চেহারা’ তুলে ধরার আহ্বান জানান।

শুধু আফগানিস্তানে নয়, Do Not Touch My Clothes এই আন্দোলন বাংলাদেশের জন্যও খুবই প্রাসঙ্গিক। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে যখন আফগানিস্তানে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছিল নারীর বিরুদ্ধে, তখন কিন্তু এ দেশের অনেক নারীই মানসিকভাবে ভীত হয়ে পড়েন। কারণ, বাংলাদেশে বেশিরভাগ সময়ই বিশেষ করে নারী নিপীড়ন ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণে নারীর পোশাককে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাজির করা হয়। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনভাবে বিষয়গুলো নিয়ে তর্কবিতর্ক এবং নারীর প্রতি অশ্লীল বাক্য, গালিগালাজ করা হয়, তখন মনে হয় বাংলাদেশে অনেক তালেবান রয়েছে, যারা নারীকে তালেবানদের মতোই দেখতে চায় এবং নারীকে দেখার এই তালেবানি পুরুষতান্ত্রিক চোখ ভীত করে বাংলাদেশের নারীদের। এখানে এ বিষয়টিও বলে রাখা একবারেই প্রাসঙ্গিক, শুধু নিপীড়নের ক্ষেত্রেই নয়, আমরা প্রতিনিয়তই পাবলিক পরিসরে নারীর পোশাক নিয়ে, টিপ নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তি শুনি। এই কটূক্তির পেছনে যে কারণ বা মতাদর্শ কাজ করে সেটি একভাবে যেমন নারীবিদ্বেষী এবং অন্যভাবে নারীকে বিভিন্ন পাবলিক পরিসর, চাকরিসহ নানা ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জায়গা থেকে বাদ দেওয়ার রাজনীতি।

তাই Do Not Touch My Clothes স্লোগানকে সামনে নিয়ে যখন আফগান নারীরা তাদের বর্ণিল পোশাকগুলো তুলে একে একে বলতে থাকে ‘এটাই আমরা সংস্কৃতি, বোরকা আমার সংস্কৃতি নয় এবং ওই কালো এবং নীল বোরকা অন্য জায়গার সংস্কৃতি’ সেটি একভাবে বাংলাদেশের নারীদেরও উজ্জীবিত করে। এর পাশাপাশি আমরা আরও সাহসী কয়েকজন আফগান নারীর বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আফগানিস্তানে গ্রাফিতি শিল্পী সামসিয়ার একটি ছবি। যেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক কালো বোরকা পরা নারীর মধ্যে বইয়ের আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারী আলো ছড়াচ্ছেন।

রাস্তায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালেবানদের নারীবিদ্বেষী আচরণ এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখে এবং বিভিন্নভাবে এটিকে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আফগান নারীরা একভাবে বিশ্বের সব নারীকে শক্তি জোগাচ্ছে এবং জানাচ্ছে কীভাবে অনেক বেশি চাপের মধ্য দিয়েও আন্দোলন এবং প্রতিবাদ চালিয়ে রাখা যায়।

তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে যা ঘটছে এবং পাশাপাশি নারীরা যেভাবে লড়ছে এই দুটোকেই বিশ্লেষণ করতে হবে সমানভাবেই। তাই এ মুহূর্তে আফগান নারীদের পাশে বাংলাদেশের নারীদের থাকতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com