ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

জোবাইদা নাসরীনবেশ কয়েক বছর ধরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আলোচিত হচ্ছে। সেটির বিস্তৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। শিক্ষক সম্পর্কে যে রোমান্টিক ধারণা ছিল একভাবে সেটি যেমন ভেঙে পড়েছে অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের নানা আচরণ নিয়েও  চলছে হতাশা।

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষিকা কর্তৃক ১৪ জন ছাত্রের চুল কাটার ঘটনা এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে আবারও ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।

এরমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফুড প্রসেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০ ও ১৭তম ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অসদাচরণ, পরীক্ষার নিয়ম অনুসরণ না করা, রূঢ় আচরণ করা এবং সুপারভাইজারকে অসহযোগিতা করার কারণ দেখিয়ে পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার হয়েছে। তবে বহিষ্কৃত হওয়া ওই শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, লুঙ্গি পরে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে তাদের শিক্ষকরা জুম প্ল্যাটফর্ম থেকে বহিষ্কার করেন। সেদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে এবং তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যদিও পরে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়।

এ তো গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। স্কুলও পিছিয়ে নেই এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি, বাগেরহাটের মোংলায় বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পোশাকের অংশ হিসেবে সাদা জুতা না পরায় বিভিন্ন শ্রেণির শতাধিক শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

এর আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর আগে ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা সবকিছুই আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  জারি থাকা এক ধরনের আস্থাহীনতাকে ইঙ্গিত করে।
যে সম্পর্ক হওয়ার কথা সবচেয়ে আস্থার, একে -অপরকে সহযোগিতা করার এবং একেবারেই খাঁটি, সেই সম্পর্ক যে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে, তার প্রমাণ এখন আমরা প্রায়ই পাচ্ছি।

এখন আমাদের প্রয়োজন কেন এটি হচ্ছে এবং এ থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় কী কিংবা আদৌ উত্তরণ নিয়ে ভাবা প্রয়োজন কিনা সেটিও আলোচনায় আনতে চাই।

এখন দেশজুড়েই দোষারোপের সংস্কৃতি বিরাজ করছে সেটি যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে সত্য, তেমনি কার্যকর আছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তাই শিক্ষকরা যেমন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, তেমনই শিক্ষার্থীর নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই অভিযোগের বিপরীতে কোনোভাবেই শিক্ষার্থী নিপীড়ন অগ্রহণযোগ্য এবং একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়। একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো শিক্ষক মানে ‘সেকেন্ড গড’। অন্তত ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধরনের ভাবনার রেওয়াজ ছিল। তাই ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার মতো সবাই ভাবতেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। পণ্ডিত মশাই মানেই অন্য জগৎ। তবে সেই ভাবনায় যে এখনও সবটাই বাতিল হয়েছে তা নয়। প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের শিক্ষকরা এখনও অনেক শিক্ষার্থীর মনোজগৎ জুড়েই আছেন। যার কারণে এখনও দেখা যায়, ফেসবুকে প্রিয় স্কুলশিক্ষকের অসুস্থতায় অনেক শিক্ষার্থীই হাহাকার করছেন এবং প্রতিষ্ঠিত অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে প্রিয় শিক্ষককে দেখতে এবং চিকিৎসার খোঁজ নিতে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একটু ভিন্ন পৃথিবীজুড়েই, সেখানে এই সম্পর্কের খোলস অনেকটাই বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিক এবং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই আসেন ১৮ বছর শেষ করে, অর্থাৎ তখন সে পূর্ণবয়স্ক মানুষ, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার কথা। তাই তাকে প্রাইমারি বা হাইস্কুলের মতো শাসন করার দরকার পড়ে না  কিংবা সেটি করতে চাওয়াটাও মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু আমাদের সমাজ অনেকটাই অপরকেন্দ্রিক। সব সময় আমরা অপরের বিষয়  নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। তাই ক্লাসে কোন মেয়ে সিগারেট খেলো, কার সঙ্গে কার সম্পর্ক, কাকে কোথায় ডেটিংয়ে দেখা গেলো, সেগুলো নিয়েও অনেক সময় আলাপে কোনও কোনও শিক্ষক জড়িয়ে পড়েন। আমরা অনেকেই ভুলে যাই এগুলো আমাদের এখতিয়ারের বাইরে।

এসব শিক্ষার্থীর একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়। ঠিক একইভাবে সে চুল বড় রাখবে কী চুল ফেলে দেবে কিংবা কীভাবে চুল বাঁধবে কিংবা আদৌ বাঁধবে কিনা সেগুলোও যেমন তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, তেমনি ওড়না পরা না পরা কিংবা ঘরে লুঙ্গি পরবে কী প্যান্ট পরবে সেটিও তার ইচ্ছা। এগুলো নিয়ে কোনও ধরনের মন্তব্য, বক্তব্য কোনোটিই যে করা যায় না সেই বোধ একজন শিক্ষকের থাকতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের দ্বারাও অনেক সময় শিক্ষার্থীরা বুলিংয়ের শিকার হন। যেমন, শরীরে বর্ণ নিয়ে, গড়ন নিয়ে,  স্মার্টনেস নিয়ে, আঞ্চলিক উচ্চারণ নিয়ে এবং ইংরেজি পারা না পারা নিয়েও শিক্ষকরা অনেক সময়ই বুলিং করেন। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার্থীর মনোজগতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

শিক্ষকদের বুলিং এবং ইচ্ছাকৃত কারও প্রতি অন্যায্য নম্বর বণ্টনের কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এর পাশাপাশি কোনও কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠেছে যৌন হয়রানির অভিযোগ।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আচরণ বিষয়ে নানা সময়ে শিক্ষকদের আক্ষেপের কথাও আমরা বিভিন্ন সময়ে জানতে পেরেছি। তবে এটি যে ব্যক্তিগত কারও আচরণ তা নয়, তার চেয়ে বড় বিষয়ে হলো এগুলো মূলত প্রজন্ম কেন্দ্রিক চর্চিত আচরণ। অনেক শিক্ষার্থীই আছেন যারা ভাববাচ্যে কথা বলেন।  আবার কেউ কেউ বলেন, ‘স্যার বলছে…’। অনেক সময় দেখি শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে আছেন, শিক্ষার্থীরা তোড়জোড় করে লিফটে উঠছেন, নামছেন, শিক্ষকদের উঠতে দিচ্ছেন না কিংবা জায়গা দিচ্ছেন না। এটি শিক্ষক বলে নয়, প্রত্যেক রাষ্ট্রেই অপেক্ষাকৃত সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মান দেখানোর সংস্কৃতি আছে। আমাদের দেশে সেটি ক্রমশ উঠে যাচ্ছে। ১ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষা নিতে গিয়েও দেখলাম, পরীক্ষা শেষে শিক্ষকরা যখন প্রশ্ন-উত্তরের ভারী ব্যাগসহ লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তখন পরীক্ষার্থীদের বলা সত্ত্বেও তারা নামছেন না। বলছেন, ‘এটি স্টুডেন্টদের জন্য লিফট, আমরা নামবো না।’ এটি কিন্তু পরীক্ষা শেষের ঘটনা। তখন তারা সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেন চাইলে। কিন্তু সেটিও করতে চাইলেন না। পরীক্ষার্থীদের গুরুত্বই আগে, নিশ্চয়ই। পরীক্ষার হলে যেতে আমরা সেটাই আগে নিশ্চিত করবো। কিন্তু পরীক্ষা শেষে যারা ভারী কাগজপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের বিষয়টাও বুঝতে হবে। এই বোঝাবুঝির সম্পর্কটা দু’পক্ষ থেকেই আসা জরুরি।

এখানে যদি আমরা শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী কাউকে একক গোষ্ঠী হিসেবে দোষারোপ করি তাহলে হয়তো সঠিক বিশ্লেষণ হবে না। আসলে এটির মূলে রয়েছে পুরো বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা। কেমন করে? একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা যাবে বিষয়টি। একযুগ ধরে আমরা যেভাবে এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ গোল্ডেন ফাইভের ছড়াছড়ি এবং এটি না পেলে অনেকটাই ‘জাত যায়’ বিষয় হয়ে গেছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই সঠিক বাক্য গঠন এবং সৃজনশীল কিছু লেখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তখন শিক্ষকরা যেমন হতাশ হয়ে পড়ছেন তেমনি যেসব শিক্ষক সৃজনশীল কিছু আশা করেন তারা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে পড়ছেন ‘প্যারাদানকারী শিক্ষক’।

সবার কথা বলছি না, তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এখন চায় কম ক্লাস, কম পড়া কিন্তু বেশি নম্বর। আবার থিসিস কিংবা অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনার বিষয়ে শিক্ষকরা কড়াকড়ি করলেও অভিভাবকদের থেকে বাধা আসে এবং ‘আত্মহত্যা’র হুমকির মুখোমুখি হতে হয়। অনেকেই চান শিক্ষকরা না পড়েই যেন নম্বর দিয়ে দেয়, এবং তাদের কষ্ট করতে না হয়। না পড়ে নম্বর দেওয়ার শিক্ষকও যে নেই তা বলছি না, কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীও সেই শিক্ষকদের সঙ্গেই কাজ করতে আরাম বোধ করেন।

সবকিছু মিলিয়েই আসলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেকটাই এখন অস্বস্তি, আস্থাহীনতা এবং মোটাদাগে বলতে গেলে মুখোমুখি অবস্থায়। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার ক্ষমতার সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই এবং এখন মনে হয় এই ক্ষমতাচর্চা যেমন শিক্ষকদের দিক থেকে অনেক সময়ই অমানবিক হয়ে উঠছে, আবার শিক্ষার্থীরাও দেখা যায় যে শিক্ষক রাজনীতির অংশ হয়ে যাচ্ছে নানা হিসাব-নিকাশ কষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগেও রয়েছে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি। সব সময় যে এই রাজনীতি রাজনৈতিক দলভিত্তিক হচ্ছে তেমন নয়, এটি হতে পারে বিভিন্ন শিক্ষকের ঘরানা এবং একে অপরের সঙ্গে মিল না হওয়াভিত্তিকও। তাই দেখা যায় অনেক শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাজনীতি করছেন, তেমনি সেই রাজনীতির অংশ হয়ে পড়ছেন অনেক শিক্ষার্থীও। তাদের উদ্দেশ্য ‘ভালো ফল’, আর শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে থাকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে বিরোধী পক্ষকে হেনস্তা। সেই রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা একদল শিক্ষকের পক্ষ নিয়ে অন্য শিক্ষকদের অপদস্থ করছেন কিংবা তার-তাদের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করছেন।

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ চালিয়ে গেলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, কেন এ অবস্থায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com