যখন না দেখেই অনেক কিছু বলি

রেজানুর রহমানআমরা অনেকেই কথায় কথায় বলি, এই দেশের কিছুই হবে না। এই দেশের মানুষ ভালো নয়, রাজনীতি খারাপ, সংস্কৃতির উন্নয়ন বলতেও কিছুই হয়নি। ক্রিকেট ছাড়া খেলাধুলার কোথাও কোনও উন্নতি নেই। আগের দিনের গান ভালো ছিল, সিনেমা ভালো ছিল। এখন সিনেমা তো নেই... এ ধরনের আরও কত ধরনের অনুযোগ, অভিযোগই না আমরা করি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে অভিযোগগুলো ঠিক? আমরা কি সবকিছু দেখে বলি? নাকি কথার কথা বলতে হয় তাই বলি?

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৫টি হলে প্রতিদিন গঙ্গা-যমুনা নামে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হচ্ছে। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের অনেক সংগঠন প্রতিদিন পালা করে নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, দলীয় সংগীত পরিবেশন করছে। প্রতিদিন শিল্পকলার ৩টি হলে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। প্রবেশ মূল্য মাত্র ১০০ টাকা। অথচ সেভাবে দর্শকের উপস্থিতি নেই। উৎসব মানে হইচই আর আনন্দ। হতে পারে করোনাভীতির কারণে দর্শক আসছে না। তাহলে কী প্রশ্ন দাঁড়ায় না, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আসার ক্ষেত্রেই কী করোনাভীতি কারণ হয়ে দাঁড়ায়? রাস্তাঘাটে তো করোনাভীতি নেই। যানজটে নাকাল রাজধানী। বাজারে প্রচণ্ড ভিড়। হোটেল রেস্তোরাঁয় গিজ গিজ অবস্থা। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। শুধু ভিড় নেই, নাটক, গান, সিনেমা, নাচের অনুষ্ঠানে। তার মানে সংস্কৃতির এই বিষয়গুলো কী আমাদের কোনও প্রয়োজন নেই? একসময় সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩শ’ । সেখানে এখন সারা দেশ মিলে ১০০ সিনেমা হলের অস্তিত্বও পাওয়া যাবে না। তার মানে, এই দেশে কি তাহলে সিনেমার দরকার নেই? এমন যদি হতো, আমরা গান শুনি না, সিনেমা দেখি না, তাহলে না হয় একটা কথা ছিল। আমরা ঠিকই গান শুনি। বিছানায় শুয়ে গান শুনি, হেঁটে হেঁটে গান শুনি, গাড়িতে যেতে যেতে গান শুনি। কিন্তু কার, কাদের গান? অন্য দেশের গান! আমাদের দেশের গান শুনি না কেন? সহজ উত্তর– আমাদের দেশে আগের মতো গান হয় না! যদি প্রশ্ন করি– আপনি কি শুনে বলছেন? তখন হয়তো অনেকেই আমতা আমতা করবেন। হয়তো বলবেন, শোনার সময় কোথায়? লোকে বলে, তাই আমিও বলি...।

কী চমৎকার সরল স্বীকারোক্তি। লোকে বলে, আমিও তাই বলি। কিন্তু এই বলাবলির মুখ্য মানসিকতায় নিজেদের যে কতটা ক্ষতি করছি তা হয়তো এখন বুঝতে পারছি না।

গেলো, গেলো সব গেলো... আমাদের দেশে অহংকার করার মতো কী আছে বলেন? যারা এ কথা বলেন, তাদের চিন্তাধারার একটা নমুনা তুলে ধরছি। শিল্পকলা একাডেমিতে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে আমাদের নাটকের দল ‘এথিক’-এর নাটক ছিল। পরিচিত একজনকে খবরটা জানালাম। ভদ্রলোক বেশ শিক্ষিত। বড় পদে দামি চাকরি করেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের নাটক কোথায় হবে?

বললাম, শিল্পকলা একাডেমিতে।

এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শিল্পকলাটা যেন কোথায়?

বললাম, সেগুনবাগিচায়।

সেগুনবাগিচার কোথায়?

দুদকের পাশে।

এবার তিনি শিল্পকলা একাডেমির ঠিকানাটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু দায়সারা ভঙ্গিতে বললেন, আজকাল কি মঞ্চে নাটক হয়? আমাদের নাটক, সিনেমা তো শেষ। কিছুই নাকি মানসম্পন্ন হয় না...।

ভদ্রলোককে থামিয়ে দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশ্ন করলাম– আপনি কি মঞ্চ নাটক দেখেন!

সময় কোথায় মঞ্চে গিয়ে নাটক দেখবো?

তাহলে কি সিনেমা দেখেন?

মাঝে মাঝে দেখি, বিদেশি সিনেমা....।

দেশের সিনেমা দেখেন না?

ভদ্রলোক এবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন– বাংলাদেশে এখনও সিনেমা হয় নাকি? বহু বছর সিনেমা হলে যাই না... গিয়ে কী করবো? সিনেমা তো নেই।

সত্যি কথা বলতে কী, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। তবে মনে কষ্ট পেয়েছি। আমরা না দেখে, না বুঝে কেন নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলি? আমরা কি একটুও ইতিবাচক হতে পারি না? কথায় আছে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। নিজেদের সংস্কৃতি যদি সমৃদ্ধ না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎটা কেমন হবে?

আমাদের সিনেমা নিয়ে কতই না নেতিবাচক কথা হয়। আমাদের সিনেমার ইতিবাচক দিকও তো আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখলাম গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশসেরা নায়ক শাকিব খান একটি নতুন সিনেমার শুটিং করছেন। হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় করেছেন। তার মানে আমাদের সিনেমার জনপ্রিয়তা এখনও আছে। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে পারছি না। এই মুহূর্তে নবীন প্রবীণ মিলে প্রায় একডজন পরিচালকের নতুন সিনেমার নির্মাণকাজ চলছে। এই যে সিনেমাগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো মুক্তি পাবে কোথায়? একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। ভালো সিনেমার জন্য ভালো সিনেমা হলেরও প্রয়োজন। বিষয়টিকে কি আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি?

বর্তমান সময়ে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে হাতে যদি থাকে একটি স্মার্ট ফোন তাহলে বোধকরি আর কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে আমরা সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছি। এর ফলে অনেকেই ভুলে যাচ্ছি নিজের দেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে। কিছু একটা হলেই তুলনা করছি অন্য দেশের সঙ্গে। ওদেরটা অনেক ভালো। আমাদেরটা মোটেই ভালো নয়। এমন অশুভ মানসিকতা দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে। অনেকেই নাটক সিনেমায় আজকাল কনটেন্টের কথা বলেন! খোলামেলা মানেই সাহসী কনটেন্ট! ওরা মেয়েদের শরীর দেখায়। আমরা দেখালে দোষ কোথায়? এ ধরনের অশুভ, অস্বাস্থ্যকর যুক্তি দেখিয়ে অনেকে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। এই প্রবণতাও ভবিষ্যতের জন্য সুখকর নয়।

আমাদের দেশে একসময় টিভি ধারাবাহিকের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। বিটিভির ঢাকায় থাকি, এই সব দিন রাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই নাটকের কথা কম-বেশি সবার জানা আছে। চ্যানেল আইতে জোয়ার ভাটার কথাও অনেকের মনে আছে। বর্তমান সময়েও এনটিভিসহ বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে ধারাবাহিক নাটক প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় ডাবিংকৃত বিদেশি ধারাবাহিক নাটক চলছে প্রায় অধিকাংশ টিভি চ্যানেলে। নাটকের ভাষা বাংলা। কিন্তু অনেক নাটকের কাহিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই নয়। এসব টিভি ধারাবাহিকের দর্শক যে নেই তা বলা যাবে না। দর্শক আছে। কিন্তু এ ধরনের বিদেশি ধারাবাহিক প্রচারের ফলে দর্শকের মানসিক চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের টিভি ধারাবাহিককে দর্শক এমনটাই আধুনিক কারিগরি দক্ষতায় দেখতে চাচ্ছে। এজন্য বিরাট বাজেটের প্রয়োজন। দেশের কোনও টিভি চ্যানেলের পক্ষে এই বাজেট খরচ করা সম্ভব নয়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একটা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি আমরা। স্রোতটা কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানি না? এই না জানা, এটাই ভয়ংকর। শুধু টেলিভিশন নয়, আমাদের নাটক, গানবাজনা চলচ্চিত্র সার্বিক অর্থে সংস্কৃতির মূল্য গন্তব্য কোথায় সেটা বোধকরি কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। সময় থাকতেই বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে হয়তো একটা বড় ভুল হয়ে যাবে। অনেক বড় ভুল...

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।