দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কি কোনও প্রতিকার নেই?

জোবাইদা নাসরীনদেশে কয়েকদিন ধরে চলছিল অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। এ কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দেখা দেয়। রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, অথচ যানবাহন নেই। কিংবা স্বল্পসংখ্যক যানবাহন থাকলেও ধাক্কাধাক্কি করে ওঠা যাচ্ছে না– এমন কিছু চিত্র আমরা গণমাধ্যমে কয়েকদিন দেখেছি। গত ৩ নভেম্বর বেড়েছে ডিজেলের দাম। অনেকটা হঠাৎ ১৫ টাকা বা ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা নির্ধারণ করে জ্বালানি বিভাগ। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পণ্যবাহী গাড়ির মালিক-শ্রমিকদের সংগঠন ৪ নভেম্বর সকাল থেকে ‘ধর্মঘট’ শুরু করে। শুধু দূরপাল্লার বাস নয়, প্রতিটি জেলার অভ্যন্তরে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখা হয়।

শুক্রবার (৫ নভেম্বর) থেকে মানুষের দুর্ভোগ লক্ষ্য করা গেছে। সেদিন বিভিন্ন ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যানবাহনের জন্য পরীক্ষার্থীদের হাহাকার ও ছুটোছুটি ছিল লক্ষণীয়। শুক্র ও শনিবার বন্ধের পর রবিবার কর্মব্যস্ত ঢাকা আবারও চঞ্চল হয়ে উঠতেই পরিবহন সংশ্লিষ্ট মূল সমস্যা আরও প্রকট রূপ নেয়। স্বস্তির বিষয় হলো সেই ‘ধর্মঘট’ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তবে আমার এই লেখার মূল জায়গা কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা পরিবহন ‘ধর্মঘট’ নয়; বরং এর চেয়ে অনেক বেশি মৌলিক যে বিষয়, সেই দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে।

শীতের হাওয়া গায়ে লাগছে। হিসাব মতো শীতের নানান সবজি এখনই বাজারে আসার কথা। দেশের সবশ্রেণির মানুষ সেভাবেই অপেক্ষা করে। কারণ এই তিন-চার মাসই বাহারি সবজি খাওয়ার সুযোগ ও দাম নাগালে থাকবে বলে সবাই ভাবে। তবে এখন আর শীতের সবজি বলে আলাদা করে কিছু নেই। সব মৌসুমেই হয়তো পাওয়া যায়। তাই সব মৌসুমের সবজিতেই ঠাসা থাকে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার এবং সুপারশপ।

বেশিরভাগ সবজির দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি। অথচ এখন সবজির দাম অনেক কম থাকার কথা। দৈনন্দিন কাঁচাবাজারের হিসাবের খাতা নিয়ে বসে প্রতিদিনই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অনেকেরই। তাই সবজির বাজার এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দরিদ্ররা তো বটেই, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন এবং প্রায়ই এক-দুটি সবজি কিনেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাদের। শুধু সবজিই নয়, বেড়েছে ভোজ্যতেল, মসলাসহ সবকিছুর দাম।

আমি নিজেও কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছি, ৬০০-৭০০ টাকার সবজি কিনে আনলে মাত্র দুই-তিন দিন খেলেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। শীতের সবজি ৮০ টাকার নিচে নেই। কয়েকদিন আগেও গাজর ছিল ২০০ টাকা কেজি। এখন ১২০-১৩০ টাকা। বাজারে কাঁচামরিচের কেজি ১২০-১৩০ টাকা। বরবটি ৯০-১০০ টাকা কেজি।

বাজারে নতুন আসা আকারে অনেকটা ছোট বাঁধাকপির দিকে চোখ যেতেই বিক্রেতার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘একদাম ৫০ টাকা।’ ছোট ফুলকপির দাম ৫০-৬০ টাকা। কেজিপ্রতি কুমড়া ৪০-৫০ টাকা, বেগুনের দাম ৭০-৮০ টাকা কেজি, কচুরমুখী ৫০ টাকা, শসা ৫০-৭০ টাকা।

শীতের লাউ খাওয়ার শখ অনেকেরই। কিন্তু একেকটি লাউয়ের দাম এখন ৫০-৬০ টাকা। শাকের দামও চড়া। পুঁইশাকের আঁটি ৩০-৩৫ টাকা এবং লাল শাক ২৫-৩০ টাকা আঁটি। তবে বাজারভেদে সবজির দাম কমে আসার চেয়ে বরং আরও বেশি হয়ে থাকে ঢাকায়।

গতকাল সরিষা তেল কিনতে গিয়ে দেখি লিটারে এখন ২০ টাকা বেশি। কারণ জানার চেষ্টা করলাম। কোনও ধরনের রাখঢাক না রেখেই বিক্রেতা বললেন, ‘অন্য সবকিছুর দাম তো বাড়ছে। সেখানে তো কারণ জানতে চাইলেন না, আমার এখানে কেন জানতে চাচ্ছেন?’

অনেকেই আমার মতো ভেবেছিলেন, শীতকালীন সবজি বাজারে এলে অন্যান্য সবজির দাম কমে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। তাছাড়া গত তিন দিন পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বাজারে পর্যাপ্ত সবজি না আসায় দাম ছিল চড়া। বাজারে গিয়ে মনখারাপের পাশাপাশি অনেককেই বিমর্ষ দেখিয়েছে।

গ্রামে হয়তো অনেকেই আশপাশ থেকে শাক জোগাড় করেন। কিন্তু শহরে তো সব জিনিসই কিনতে হয়। তাই বাজারের এই অবস্থায় দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের যে কী অবস্থা হচ্ছে তা সহেজই অনুমেয়। মধ্যবিত্তের চেহারায় হতাশা স্পষ্ট। কিন্তু দরিদ্ররা আদৌ তিনবেলা খেতে পারছে কিনা সেই খবর আমরা রাখি না।

আমার বাসার কাজে সহায়তাকারী আপার চোখে মুখে কিছু আক্ষেপ ও ক্রোধ দেখতে পাই। তিনি প্রায়  প্রতিদিনই বেশ আক্ষেপ করেন। আগে একদিন পরপর ২০০ টাকার বাজার করতেন। সেই ২০০ টাকার বাজার দিয়ে তার ছয় সদস্যের পরিবারের তিনবেলা খাবার হতো। এর বাইরে পেয়াজ, তেল তো আছেই। যদিও ২০০ টাকায় বেশিরভাগ সময় শাক আর ডালই খেতেন। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আর তা পারছেন না। শাকও এখন প্রতি আঁটি ৩০-৪০ টাকা। এখন শুধু আলু ও ডাল খাচ্ছেন তিনি। কাল এসেই কিছুটা রাগের স্বরে বলেন, ‘গাড়ি বন্ধ কইরা লাভ আছে? খাওনই তো নাই ঘরে। সবাই তাইলে ক্যামনে খাইতাছে? সেখানেও যে আগুন ধাইরা আছে কেউ দেখতেছে না? সেইটা নিয়া প্রতিবাদ করতাছে না কেন? সেইটা নিয়া কেউ ধর্মঘট ডাকেতাছে না ক্যান? এইটা নিয়া সবাই একটু বাস ওয়ালাদের মতো সব বন্ধ কইরা দিতো তাহলে তো আমরা একটু বাঁচতাম।’

আসলেই বাঁচার পথগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে...

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


zobaidanasreen@gmail.com