‘বাং-পাকিস্তানিদের’ মনন ও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের আগ্রাসী আচরণ

মো. জাকির হোসেন‘বাং-পাকিস্তানি’ বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যাদের জন্ম এই দেশে কিন্তু ওরা এই দেশি কেবল কাগজে-কলমে, অন্তরে-আনুগত্যে নয়। এরা এই দেশে জন্মেছে। এই দেশে থাকে, খায়, পড়াশোনা করে, আয়-রোজগার করে। এ দেশের আলো-বাতাসে, স্নেহ-মমতায় বড় হয়। কিন্তু কোনোদিন এরা দেশটাকে আপন ভাবে নাই। বাবর আজম ভালো খেলে বলে সমর্থন করে না। ভালো খেলার জন্য সমর্থন করলে খেলা শেষে ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কেন আলাদা হয়ে গেলো’ এই পরিতাপ করতো না। কিংবা ‘পাকিস্তান বাংলাদেশ দুটো একই দেশ দু’টোই ভাই ভাই, যে হারুক-জিতুক আমাদের কোনও সমস্যা নাই’ এই কথা বলতো না।

পাকিস্তানের জার্সি পরে পাকিস্তানের পতাকা হাতে ‘পাকিস্তান পাকিস্তান’ বলে চিৎকার করতো না, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’  স্লোগান দিতো না। এরা মানতে চায় না যে বাংলার জমিনে তারা চলাফেরা করে, তাদের আহার জোগায় যে বাংলার মাটি তা অতি চড়া মূল্যে পাওয়া। ৩০ লাখ শহীদ আর ৪-৫ লাখ কন্যা-জায়া-জননীর চরম উৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত এই রাষ্ট্রটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার নৃশংস এক বিয়োগগাথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মনুষ্যত্বের অমোচনীয় এক কলঙ্ক সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসররা। এত অল্প সময়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে আর কোথাও প্রাণ দিতে হয়নি, এত বেশি নারীকে আর কোথাও নির্যাতিত হতে হয়নি। পাকিস্তান ও তার এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র ও নৃশংসতা কুখ্যাত হিটলারকেও হার মানায়। জবাই করে, চামড়া তুলে, গুলি করে, পুড়িয়ে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নানা নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয় ৩০ লাখ বাঙালিকে। বাঙালি জাতিসত্তাকে পাল্টে দিতে বাঙালির ধমনীতে পাকিস্তান আর তাদের দোসর ধর্ষকদের নাপাকি রক্ত মিশিয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে ৪-৫ লাখ বাঙালি রমণীকে ধর্ষণ করা হয়। এ বিষয়ে পাকি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তাঁর ‘A Stranger In My Country: East Pakistan,1969-1971’ গ্রন্থে লিখেছেন, Gen. Niazi told his officers to let loose their soldiers on the women of East Pakistan till the ethnicity of the Bengalis was changed. মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ডান কলিন পাকিস্তানি বাহিনীর নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে একটি রিপোর্ট করেন, তা ২৫ অক্টোবর সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, একটি বীভৎস ঘটনা হলো, ঢাকার একটি সামরিক ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছে ৫৬৩ জন বাঙালি যুবতীকে। এরা সবাই এখন গর্ভবতী। তাদের গর্ভপাত ঘটানো সম্ভব নয়। প্রতিবেদনটি তখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নারীদের যে ব্যাপক সংখ্যায় ও নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে তা বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে বীভৎসতম ঘটনাগুলোর একটি। শিশু থেকে বৃদ্ধা, অন্তঃসত্ত্বা, প্রসূতি যাকে ধরতে পেরেছে কাউকেই তারা রেহাই দেয়নি।

একাত্তরের ২০ মে ভারত থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকায় ‘পাকিস্তানে নারীত্বের চরম লাঞ্ছনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, কুষ্টিয়া জেলার জীবননগর থানার স্যানহুদা গ্রামে ১৮ বছর বয়স্কা বিবাহিতা দুই নারীকে রাইফেল দেখিয়ে জোর করে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ফেলে। সৈন্যরা উলঙ্গ অবস্থায় তাদের সমগ্র গ্রাম ঘুরিয়ে এনে ধর্ষণ করে এবং অচেতন অবস্থায় গ্রামের এক পাশে তাদের ফেলে আসে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জীবননগর থানার উতলী গ্রামে সৈন্যরা ছয় জন তরুণীকে ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর জুলুম করে। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। ওই থানার নূরনগর গ্রামে ১৪ বছর বয়স্কা জনৈকা মুসলমান কিশোরীকে সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার শেষে তার দেহ দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। কয়েক দিন মেয়েটির জ্ঞান ফেরেনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সেবা দেন। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় এই চিকিৎসকের কাজ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ডা. জিওফ্রে ডেভিসের বরাত দিয়ে বলা হয়, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রূণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে 'নষ্ট' করেছে। তিনি বলেন, পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে ধরে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এই তরুণীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়তো হত্যা করা হয়েছে। কোনও কোনও এলাকায় ১২ ও ১৩ বছরের বালিকাদের শাড়ি খুলে নগ্ন অবস্থায় রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে, যাতে তারা পালিয়ে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে না পারে। জিওফ্রে ডেভিসের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের ফলে গর্ভধারণ করেছেন এমন নারীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ এবং প্রায় চার লাখ ৩০ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালানোর পর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কমপক্ষে চার লাখ ৬৮ হাজার। এরমধ্যে নিজ গৃহে কিংবা আক্রমণের স্থানে তাৎক্ষণিক ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ২৭ হাজার ৬০০ জন, যাদের প্রায় ৩০ ভাগ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশে প্রতিদিন তাৎক্ষণিক ধর্ষণে গড়ে তিন হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের সহযোগী ছিল প্রায় ছয় হাজার বিহারি ও দালাল। নির্যাতিত নারীদের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে কমিটি আরও জানায়, পাকিস্তানি বাহিনী, বিহারি, রাজাকার ও দালালরা অধিকৃত বাংলাদেশের শহর-গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বা এলাকায় আক্রমণ করে খুন-লুটপাটের পাশাপাশি উপস্থিত নারীদের সেখানেই ধর্ষণ করতো। আবার বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে ধর্ষণ করা হতো। তাদের কাউকে ছেড়ে দেওয়া হতো, কখনও বা হত্যা করো হতো। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করা হতো। একাত্তরে মোট নির্যাতিত নারীর শতকরা ৭০ ভাগই তাৎক্ষণিক ধর্ষণের শিকার। আর যাদের ক্যাম্পে আটকে রাখা হতো তাদের কোনও পোশাক পরতে দেওয়া হতো না, যাতে ওরা পালিয়ে যেতে বা আত্মহত্যা না করতে পারে।

কমিটি মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে কমপক্ষে সাড়ে ৭০০ নারীর সন্ধান পেয়েছিল, যাদের অপহরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাহাত্তর সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া আড়াই হাজার ‘যুদ্ধশিশু’কে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে দত্তক হিসেবে। শিশুদের অনেকেই জানে না তাদের জন্মপরিচয়। আবার জেনে মায়ের সন্ধানে এ দেশে এসেছেন এমন যুদ্ধশিশুও পাওয়া গেছে।

গ্যালারিতে পাকিস্তানের পতাকা হাতে উল্লাসের পাশাপাশি আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের আগ্রাসী আচরণ ও ঔদ্ধত্য। বাংলাদেশি ক্রিকেটারের রান নেওয়ার সময় লাথি মারতে উদ্ধত হওয়া, ক্রিজে থাকা বাংলাদেশি ক্রিকেটারকে বিনা প্রয়োজনে টার্গেট করে বল ছুড়ে মেরে আহত করা, বাংলাদেশি ব্যাটার আউট হলে অবমাননাকর আচরণ-ইঙ্গিত করা কোনোভাবেই খেলার অংশ নয়। তাদের এই আচরণের জন্য তারা বিশ্ব ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী শাস্তিপ্রাপ্তও হয়েছে।

পাকিস্তানি একই ক্রিকেটাররা সদ্য সমাপ্ত টি-২০ বিশ্বকাপে খেলে এসেছে। সেখানে তারা এমন আগ্রাসী ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেনি। প্রশ্ন হলো, ভদ্রলোকের খেলা খ্যাত ক্রিকেটে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের বাংলাদেশে কেন এমন আগ্রাসী আচরণ? এর সবই হয়েছে জাতিগত আক্রোশ থেকে, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধমূলক মানসিকতা থেকে। যারা অস্বীকার করতে চান তাদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বার্সা আর রিয়ালের রাইভালরি শুরুই হয়েছিল কাতালান আর স্প্যানিশ জাতিগত পরিচয়ের সংঘাত থেকে।

দেশপ্রেম জোর করে আদায় করা যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে পাকিস্তানের জার্সি গায়ে পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে আসা, পাকিস্তানকে সমর্থন করা, পাকিস্তানের সাফল্য-জয়ে উল্লাস করা রীতিমতো গ্লানির, দৈন্যের। পৃথিবীর ঘৃণ্যতম দৃশ্য নিজের দেশের খেলার দিন রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধের প্রধান শত্রুর পতাকা হাতে উল্লাস! পাকিস্তানের মহব্বতে মাতোয়ারা বাংলাদেশের কেউ হতে পারে না।

আক্ষেপ হলো, যারা বিশ্বাস করে এবং বলে ‘দুর্ভাগ্য আমাদের দেশটা পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে গেলো এটাই আমাদের কষ্ট’, কিংবা ‘দুই পাকিস্তানকে আলাদা করা ভুল ছিল, এটা ভারত তার স্বার্থে করিয়েছে’ এই অসুস্থ মানসিকতার বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গেই আমাদের থাকতে হচ্ছে। লাখো শহীদের জীবন ও কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই রাষ্ট্র ও তার সব সুযোগ-সুবিধা বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে ভাগ করতে হচ্ছে। অনেকেই বলছে, খেলার মাঠের এগুলো ট্রেইলার মাত্র, সামনে আরও ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে। সাধু সাবধান!

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com