কে কোনও রাজনীতি করবেন, কোন দল কাকে নেবে বা নেবে না, সেটা নিশ্চয় ঠিক করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে যখন সেটা একটা ‘ট্রেন্ড’-এর চেহারা নেয়, তখন তা ব্যক্তি বা দলের সীমা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাঠ হয়ে ওঠে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ভাষায় যাকে ‘কাউয়া’, ‘হাইব্রিড’ বা অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে এবং প্রক্রিয়াটাকে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ‘পদ বাণিজ্য’ ইত্যাদি নামে নামকরণ করা হচ্ছে।
দল ভাঙাভাঙি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর মজ্জাগতই ছিল। এখন নতুন অভ্যাস সৃষ্টি হচ্ছে। দলের ভেতর বাণিজ্য করা। মতবিরোধ বা বঞ্চনাবোধ বরাবর ছিলই। এখন সৃষ্টি হচ্ছে জিঘাংসা এবং সেটা থেকে খুনাখুনি। চলতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এ পর্যন্ত কত সহিংস ঘটনা ঘটেছে, কতজন খুন হয়েছেন, কতজন আহত হয়েছেন সেটা হিসাব করা বড় কঠিন। কারণ, প্রতিদিনই সংখ্যাটা বাড়ছে। এ লেখা যখন লিখছি তখন টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজ– কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ মোহাম্মদ সোহেলকে তার কার্যালয়ে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় গুলিতে নিহত হন তার সহযোগী হরিপদ সাহা। আরও আট জন আহত হয়েছেন। সোমবার বিকালের ঘটনা এটি। লোমহর্ষক সব ঘটনা ঘটেই চলেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নেই নির্বাচনে, তাই ধানের শীষ প্রতীকও নেই। তবু প্রার্থীদের জন্য প্রতিপক্ষের অভাব নেই।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেওয়ায় সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে – এ কথা অনেকেই বলেছেন। তবে দলের নীতিনির্ধারকরা হয়তো ভেবেছিলেন, এর মাধ্যমে তৃণমূলের রাজনীতিতে উঠে আসবেন তরুণরা। আসছেনও এবং আবার এদের অনেকে বিতর্কিতও হচ্ছেন, যেমনটা হয়েছেন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু মনোনয়নে বাণিজ্য সংস্কৃতি প্রবেশের কারণে দলের ভেতর বিদ্বেষ বিভাজন বাড়ছে। আর বাড়ছে অরাজনৈতিক চর্চা যেমন – চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বিতর্কিত মন্তব্যসহ দলের নীতি–আদর্শের পরিপন্থী কাজ।
ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে যা ঘটছে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। এত খুনাখুনি, এত বিরোধ, বিবাদ এসবের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের স্খলনই কি শুধু দায়ী, না এর জন্য বড় নেতাদেরও দায় আছে? টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অবস্থা যদি এই হয় তাহলে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে কী করে? এমন নানা প্রশ্ন উঠে আসছে খোদ শাসক দলেরই অনেকের আলাপ-আলোচনায়।
দিনশেষে কারণটাও রাজনৈতিকই। রাজনৈতিক অভিমুখ এবং মতাদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটা চলে যাচ্ছে পেছনে। বিভিন্ন স্তরে একপ্রকার নেতা সৃষ্টি হয়েছে, যারা অন্য স্তরের নেতা ও কর্মীদের কাছ থেকে শুধু আশা করেন ‘প্রশ্নহীন আনুগত্য’। অবস্থাটা বেশি খারাপ হচ্ছে যখন খাতায়-কলমে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষও আওয়ামী লীগে যোগ দিতে সমস্যা থাকছে না, পদ পদবি এমনকি নির্বাচনে দলীয় টিকিটও পেয়ে যাচ্ছেন। ভিন্ন মেরুর বাসিন্দাকে দলে নিতে গিয়ে দলের খাঁটি নেতাকর্মীদের হৃদয় কতটা বিচূর্ণ করা হচ্ছে সে হিসাব কে রাখছে?
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে এই দল থেকে ও দলে যাওয়া যাবে না। এটা বহু আগে থেকেই ঘটে আসছে। কিন্তু একটা তফাত অবশ্যই আছে। যেভাবে মুহুর্মুহু এ দল ও দল থেকে, বা একেবারে রাজনৈতিক ইতিহাসবিহীন লোক মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন, সেটা একটা হিড়িক বা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, সেটা এই আকারে আগে দেখা যায়নি। এমন এক ট্রেন্ডের সৃষ্টিই জাহাঙ্গীর।
স্থানীয় ডাকসাইটে নেতাদের বঞ্চিত করে তিনি কীভাবে মেয়র হলেন এবং আবার ছিটকে পড়লেন সেটা এক পলিটিক্যাল কেইস স্টাডি হতে পারে। তবে কারা তাকে আনলেন এবং এত উপরে তুললেন তাদের পরিচয়টা আর জানা গেলো না। এমন অনেক ‘জাহাঙ্গীর’কে দেশব্যাপী মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে বলে এখন আওয়াজ উঠেছে।
ইচ্ছে-খুশি মতো ঘরে নিয়ে আসা, মনোনয়ন ও পদ দেওয়ার এই ঊর্বর জমি কীভাবে তৈরি হলো? এই সংস্কৃতি আসলে অনেকখানি সাম্প্রতিক রাজনীতির নিজস্ব গতিবিধিরই অবদান। পদ ও পদবি কেনাবেচা ক্রমশ একটা শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। স্থানীয় সরকার ভোটের সময় সেই ফর্মুলা আরও বেগবান হয়।
সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতি তার প্রকরণে, অনুশাসনে, কৌশলে এবং মূল্যবোধে একটা বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানা দলীয় কার্যকলাপের মধ্যে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সবকিছুর মধ্যে একটা আগ্রাসী চেহারা। ভালো সংগঠক, ভালো কৌশলী, ভালো বক্তা, ভালো তাত্ত্বিক - এসবই যেকোনও দলের জন্য সম্পদ ছিল একসময়। কিন্তু এখন আর নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে গেছে সেখানেই।
লেখক: সাংবাদিক