রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে এমন একটি সময়ে যখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের অভিঘাতে দুটো বিরুদ্ধ রাজনৈতিক জোট বা বলয়ে বিভক্ত ছিল। এর এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য পক্ষের নেতৃত্বে ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। এ দুটো দেশ মূলত যথাক্রমে পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন দেয়, অপরদিকে ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাজ্য এবং কানাডার সরকার ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে সহানুভূতিশীল ছিল। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সৌদি আরব এবং লিবিয়া মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে (সিরু বাঙালি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ বহির্বিশ্বে শত্রু-মিত্র, ২০১১, পৃ. ২)।
উল্লিখিত রাষ্ট্রসমূহ ছাড়াও আরও অনেক দেশ ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে কার্যকর এবং সফলভাবে টিকে থাকার জন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ এবং দলমত নির্বিশেষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে যখন ঢাকায় খসড়া সংবিধান প্রণয়নের কাজ চলছিল তখন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশের আবেদন মূলত চীনের আপত্তির কারণে নিরাপত্তা পরিষদের অনুকূল সুপারিশ পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে সেই বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে অসমর্থ হয়। এ প্রসঙ্গটি গণপরিষদে মো. আজিজুর রহমানের বক্তব্যে উঠে এসেছে। ২৬ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে গণপরিষদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছেন–
“জাতিসংঘকে আমি আহ্বান করি, আপনারা আমাদের মেম্বারশিপ দিন। আমরা আজও বলছি, চীনের সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নাই। তাঁরা মানবিক অধিকার যদি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে তাঁরা সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাংলার স্বাধীন মানুষকে স্বীকৃতি দিন।”
উপরিউক্ত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, দারিদ্রপীড়িত, নবীন দেশের জন্য সাংবিধানিকভাবে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা ছিল বাস্তবসম্মত। সংবিধানে যুগপৎ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ এবং ২৫ অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্তি স্পষ্টতই বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছে। খুব সম্ভবত এ কারণেই সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত যখন গণপরিষদে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানকে একটি ‘মধ্যপন্থা’বলে অভিহিত করেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ সদস্যবৃন্দ তার কোনও প্রতিবাদ করেনি। জোটনিরপেক্ষতাকে পররাষ্ট্রনীতি হিসাবে গ্রহণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত গণপরিষদে প্রথম পাওয়া যায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জন্য একটি জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি সংবলিত সংবিধান গ্রহণ করা হবে (গণপরিষদ বৈঠক, ১৯ অক্টোবর ১৯৭২)। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধু এর অনেক আগে থেকেই জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে ছিলেন। পাকিস্তান ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালে যথাক্রমে সিয়াটো এবং সেন্টো জোটভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মার্কিনপন্থী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুসৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সময় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। [মঈদুল হাসান, উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল, ২০১৫, পৃ. ৬২]
অবশ্য সমাজতান্ত্রিক জোটে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি বা প্রত্যাশা যে গণপরিষদে একেবারে উত্থাপিত হয়নি তা নয়। এ সম্পর্কে গণপরিষদে সাধারণ আলোচনার পর্যায়ে আছাদুজ্জামান খানের বক্তব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ২৫ অনুচ্ছেদের ওপর পাওয়া একটি সংশোধনী প্রস্তাবের কথা গণপরিষদে উল্লেখ করেন, যথা-
‘সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাষ্ট্রগুলোর সহিত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা, সাম্রাজ্যবাদী জোটসমূহে যোগদান না করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা– এইসকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।’[গণপরিষদ বৈঠক, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭২]
আছাদুজ্জামান খান উল্লিখিত সংশোধনীর বিরুদ্ধে এ বলে যুক্তি দেন, খসড়া সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদের পরিধি উপরিউক্ত সংশোধনী দিয়ে যা দাবি করা হয়েছে তার তুলনায় কার্যত অনেক বেশি। তাঁর মতে এ অনুচ্ছেদের ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।
উল্লেখ্য, সংবিধান-বিলের দফাওয়ারি আলোচনার সময় উক্ত সংশোধনী প্রস্তাব গণপরিষদে কেউ উত্থাপন করে নাই। ফলে ১ নভেম্বর ১৯৭২ খসড়া সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয় এবং তা সংবিধান-বিলের অংশে পরিণত হয়।
গণপরিষদ সদস্যবৃন্দের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখে গণপরিষদে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাবের ওপরে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারত, রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং যেসমস্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল তাদের সরকার এবং জনগণকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অধিকন্তু তিনি গ্রেট ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, জাপান এবং আমেরিকার জনগণকে (সরকার নয়) মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান করার জন্য ধন্যবাদ দেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে ভারত ও রাশিয়ার অবদানের প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য গণপরিষদ সদস্যবৃন্দের বক্তব্যে উঠে এসেছে। লক্ষণীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করলেও গণপরিষদ সদস্যবৃন্দ এ দুটো দেশের সরকারের সমালোচনা করেন নাই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁরা এই দুই দেশের সংবিধানের বিধানাবলীর সঙ্গে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের বিধানাবলীর তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। গণপরিষদ সদস্যবৃন্দের এই বাস্তববোধ সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের বক্তব্যে যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেছেন-
“...আজকে যে দেশ বন্ধু, ভবিষ্যতে সে আর বন্ধু নাও থাকতে পারে। তেমনি আবার আজকে কোনও দেশ বন্ধুভাবাপন্ন নয়, ভবিষ্যতে সেই দেশ বন্ধুভাবাপন্ন হতে পারে। যেমন, অতীতে চীন আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, কিন্তু আজ নাই। অনুরূপভাবে ভারত আজ আমাদেরর বন্ধু।” (গণপরিষদ বৈঠক, ২৪ অক্টোবর ১৯৭২)
পরিশেষে বলতে চাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির শুধুমাত্র সামরিক বিজয়ই অর্জন হয়নি, এটা ছিল একইসঙ্গে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিজয়। যে কারণে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের মধ্য থেকে চীন বাদে বাকি সবার স্বীকৃতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট