নারী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেই কি এমন হয়? সব জায়গায় কি একই চিত্র? সব জায়গায় একরকম না হলেও চিত্র অনেকটাই কাছাকাছি।
দিন দুয়েক আগেই কলাভবনেই একজন পুরুষ সহকর্মী হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘কী, আপনাদের ডিন অফিস তো শাড়ি-চুড়িমুক্ত হইলো’। এর প্রতিক্রিয়ায় আমার মুখ দেখে তিনি বললেন, ‘আরে আমি তো মজা করছি, এত সিরিয়াস হচ্ছেন কেন?’
সিরিয়াস হই এই কারণে যে আমরা জানি সবচেয়ে বেশি নারী বিদ্বেষ ছড়ানো হয় ‘মজা’র মাধ্যমে। সহকর্মীর এই ইঙ্গিতের পেছনে যে বিষয়টি ছিল তা হলো গত কয়েক দিন আগে নীল দলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের দল) প্রার্থী মনোনয়নে একজন নারী প্রার্থী হেরে যান, যিনি ডিন হিসেবে আছেন (আজকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নির্বাচন)।
হার-জিত সব নির্বাচনেই হবে। কিন্তু আলোচনা সেটি নিয়ে নয়, প্রশ্ন কেন এমন ধরনের ইঙ্গিত করতে হবে?
অনেকেই মনে করতে পারেন, সবসময় নারীর বিরুদ্ধে প্রচার হলে নারীরা জয়লাভ কীভাবে করছেন? আমাদের মনে রাখতে হবে, এখানে অনেক বিষয় কাজ করে। নির্বাচনটি যদি একসঙ্গে অনেক প্রার্থীর নির্বাচন হয় তখন সেখানে দলীয় ভোট হয়। কিন্তু যখন দুজন ব্যক্তির ভোট হয় এবং তখন এই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোন নারী থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে অনেক প্রচারণার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক। তিনি যদি ডিভোর্সি হন, তিনি যদি প্রতিবাদী হোন কিংবা তিনি যদি স্পষ্টভাষী হন তাহলে তো কথাই নেই। বলা হয়, তার সংসার ঠিক রাখতে পারেনি, তার আচরণ খারাপ, বদমেজাজি, রাগী। কিন্তু পুরুষ প্রার্থীর ক্ষেত্রে এই ধরনের বিষয় আশয় আলোচনায় আসে না। যার কারণে অনেক নারীর ক্ষেত্রেই নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়ে।
এখন তাহলে প্রশ্ন আসে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কথা মুখে মুখে এবং কাগজে কলমে থাকলেও আসলে আমরা কেমন নারী চাই রাজনীতিতে? অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, রাজনীতিতে নারীকে স্বাগত না জানালে আমাদের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে কীভাবে নারীকে মেনে নিয়েছি এবং তারাসহ আরও অনেক নারীই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
দলীয় প্রধান এবং অল্প কয়েকজন নারী রাজনীতিবিদ বাদ দিলে অন্য রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেই নির্বাচনিক কুৎসা রটনা হয়েছে অতীতে।
‘নারীরা চিল্লাচিল্লি করে ( প্রতিবাদকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়)’, ‘ব্যবহারে নমনীয়তা নাই’, ‘মুখের ওপর উচিত কথা বলে, এবং জায়গা বিশেষে ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে কাহিনি প্রচার’– সবই নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। অথচ কোনও পুরুষ প্রার্থী খুনখারাপিসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত থাকলেও সেগুলো আলোচনায় আসে না। অন্য সব দলের কথা বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের কথাই যদি পুনর্পাঠ করি, সেখানে দেখতে পাই যে আওয়ামী লীগের ইশতিহারে নারী বিষয়ে কিছু অঙ্গীকার রয়েছে। যার মধ্যে আছে উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা বাড়ানো, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, কর্মক্ষেত্রে কাজের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা। এর পাশাপাশি নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখার জন্য ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথাও বলেছে দলটি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইশতেহারে কিন্তু নারী-বিদ্বেষী অপপ্রচার বন্ধের কথাও রয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই দলটির প্রার্থীরাও এই নারীবিদ্বেষী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
ফিরে আসি সেই প্রশ্ন। তাহলে স্পষ্টতই আমাদের সামনে আসে কয়েকটি বিষয়, তা হলো রাজনীতিতে আমরা শুধু সংরক্ষিত আসনে নারীদের দেখতে চাই, সেটি স্থানীয় পর্যায়ে হোক কিংবা জাতীয় পর্যায়ে হোক। নারীদের কাজ পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা হুমকিতে পড়লেই তখনই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি সেটি ঠেকাতে। এর বাইরে কোনও পুরুষ প্রার্থীর বাইরে নারী প্রধান প্রার্থী হয়ে উঠলেই আমরা সেই নারীর বিষয়ে কুৎসা রটানো এবং সেটি প্রচারে ব্যস্ত হয়ে উঠি।
নারীরা শুধু কথা শুনবে কিংবা পুরুষতান্ত্রিক মন নিয়েই কথা বলবে, পুরুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করবে। নারী প্রতিবাদী কথা বললে আমরা ‘চিল্লাচিল্লি’ হিসেবে পাঠ করবো, কারণ আমরা এটা নারী থেকে আশা করি না। আমরা রাজনীতিতে প্রতিবাদী নারীদের স্বাগত জানাতে চাই না।
এ দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ইতিহাস দীর্ঘ। অথচ এখন পর্যন্ত নির্বাচনে নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং নারীবিদ্বেষী মনোভাব রয়ে গেছে। এর কারণ কী?
এর কারণ রাজনীতিতে যতই নারী আসুক আমরা মন থেকে মানতে পারি না যে নারীরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা অর্জন করুক। শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া যতই একটি দলের নেতৃত্বে থাকুক, তাদের দিয়ে রাজনীতিতে নারীর অবস্থান বিচার করা যাবে না কোনোভাবেই।
রাজনীতিতে যতই নারীকে স্বাগত জানান না কেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং মনোনয়ন পেলে নির্বাচনি মাঠে। এসব থেকে কী নারী আসরে কখনও মুক্তি পাবে না?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।