কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটে সেরকম অসংখ্য ঘটনায় অনেকবারের মতো এবারও মনটা খারাপ হলো। একটা বিষয় বেশ বুঝতে পারি– ব্যক্তি বদলায়, বহু কিছু পাল্টায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের সমস্যাগুলোর প্রকৃতির তেমন পরিবর্তন ঘটে না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক কতটা বিদ্বেষ আর আক্রমণাত্মক পর্যায়ে গেছে, সেটা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। শিক্ষকরা কতটা অভিভাবক আর কতটা ঝানু রাজনীতিক সে বিতর্কের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিলো, উপাচার্যরা একেকজন কতটা বড় সামন্ত প্রভু।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শুরু থেকেই অবস্থান নিয়ে আছেন। পত্রিকা আর অনলাইনগুলো লিখছে, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু যেদিন একটা সাধারণ ছাত্র সমাবেশে সাউন্ড গ্রেনেড আর মারাত্মক সব অস্ত্র নিয়ে পুলিশ পড়ুয়াদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সেদিনই প্রমাণ হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, বিশেষ করে উপাচার্য তার নিজের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের প্রীতির চোখে দেখেন না।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইরা যা করেছেন এখন পর্যন্ত সেটা হয়তো তারা শেষ অবধি প্রমাণ করবেন যে এটা বেআইনি নয়। কিন্তু এটা যে অমানবিক সেটা কি অস্বীকার করতে পারবেন? একজন উপাচার্য বয়স্ক মানুষ। বাসায় তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন। তারই শিক্ষার্থীরা সেই বাসায় বিদ্যুৎ আর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়াটাকে সবাই অমানবিক হিসেবেই বিবেচনা করবেন এবং করছেন। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি প্রিয় শিক্ষার্থীরা না চাইলেও থাকবেন, জোর করে থাকবেন, ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকবেন। কারণ একটিই আর সেটি হলো ক্ষমতা আর আধিপত্য।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরতে পরতে সকাল-সন্ধ্যা হরেক অনিয়ম আর অনৈতিকতার গন্ধ বেরোয়। হয়তো এগুলোই সৃষ্টিশীলতার চরম নিদর্শন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেসামাল। অগণতান্ত্রিক মানসিকতার এসব শিক্ষক প্রশাসক তাদের পড়ুয়াদের দিক থেকে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, কোনও প্রশ্নই চান না। অনেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবিষ্কারক হয়ে যান এমন পরিস্থিতিতে। কিন্তু তারা উপাচার্য ও কিছু শিক্ষকদের আচরণে সংগঠিত নৈরাজ্য দেখতে পান না।
ছোট্ট ঘটনা মাত্র। তবে বিন্দুই সিন্ধুর দ্যোতক। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল একটি ছাত্রী হলকে কেন্দ্র করে, অনিয়মের প্রতিবাদ করে। অথচ সেটি এখন কোথায় গিয়ে ঠেকলো! ছাত্রছাত্রীদের কড়া ধমক দিয়েও অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু এখনকার শিক্ষকরা সেই নৈতিক ধমকও দিতে পারেন না, পারেন গুণ্ডা ডাকতে, পুলিশ দিয়ে নৃশংস হামলা করাতে। এমনই অভূতপূর্ব এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এখন উচ্চ শিক্ষা জগতে।
উপাচার্যের জন্য নৈতিক ভূমিকার পথটি কিন্তু খোলাই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে প্রভোস্ট ও ছাত্রীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন ছাত্রছাত্রীদের ‘শাস্তি’দানই উত্তম পথ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও এদের মনোজগতে বেত্রাঘাতের শাসনের বিশ্বাস বর্তমান। প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা দেখেছি, মীমাংসার প্রয়াস না করে শাসনের প্রয়াস থাকে উপাচার্য ও শিক্ষকদের আচরণে। তাদের সারা জীবনের চর্চায় হয়তো নৈতিক ভূমিকার অন্বেষণটি তেমন সুবিবেচিত হয়নি কখনও। আসলে সুবিবেচনার পথটি রোধ করেছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। এরা যতটা না শিক্ষক, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক, তার চেয়ে বেশি এরা রাজনীতিক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা এ সংশ্লিষ্ট উচ্চস্তরে সংকটের মীমাংসার কোনও ভাবনা নেই। আছে অর্থহীন সব গোয়ার্তুমি।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বিভাগ, আমার হল, মাঠ আর বাগান - এও যেমন শরীরে মনে এক হয়ে যায়, তেমনি আবার হাজার দুয়ার, জানালা-খোলা মানুষ শিক্ষক হিসেবে আসেন আমাকে তেপান্তরে ছড়িয়ে দিতে। তারাই শিক্ষক। কিন্তু এমন শিক্ষক আজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। আমাদের উপাচার্য বা শিক্ষকরা এখন আর সেই বিপুল মনের সেই মানুষ নন, যারা ছাত্রছাত্রীদের জন্য গোটা ভুবনটাকেই নামিয়ে আনতে পারেন।
অনেকেই বলছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ কেমন করে করছেন শিক্ষার্থীরা? পাল্টা তাহলে বলতেই হয়, কী শেখালেন শিক্ষকরা? যদি উল্টোটা বলি তাহলে কেমন হয়? ভয়াবহতার নানা আয়োজনে ভরা গত কয়েক বছরে বা দশকে সত্যিকারের শেখার মতো প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এই ছাত্রছাত্রীরাই। তারাই আজ আমাদের শিক্ষক। ঘরে-বাইরে সংকট সময়ে মাস্টারমশাইদের খুঁজে পাই না আমরা। সেটা অনেক দিন ধরেই পাচ্ছি না। শিক্ষকতার আদর্শ ছেড়ে রাজনীতির বড় প্রাপক হয়েছেন আমাদের শিক্ষকরা। প্রাপকের তালিকা বড় হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়েনি। ইতিহাস একদিন এর বিচার করবে নিশ্চয়ই।
লেখক: সাংবাদিক