প্রদীপ, লিয়াকতের আরও কিছু অপরাধ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাপুলিশ সৎ এবং নিরপেক্ষ, সেই সঙ্গে মানবিকও। এই চিত্রটা আমাদের নয়, কিন্তু আমাদেরই হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আর সে জন্যই সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার বিশ্বাস, ‘জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্য পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন’।

এই বিশ্বাসটা মানুষও রাখতে চায়। কিন্তু কখনও কখনও পুলিশের কোনও কোনও সদস্যের অত্যাচার, অমানবিক আচরণ সেই বিশ্বাসে চিড় ধরায়। তখন পুরো সিস্টেমকেই মানুষ ভিন্ন চোখে দেখে। প্রসঙ্গটা এলো একটি রায়কে কেন্দ্র করে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার বহুল আলোচিত মামলায় সোমবার কক্সবাজারের একটি আদালত পুলিশের বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ৬ জনের। মামলার অপর ৭ অভিযুক্তকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

আদালতের বিচারক এই হত্যাকাণ্ডকে ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হলো, একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার সহকর্মীদের নিয়ে মানুষ খুনের পরিকল্পনা করেন এবং সেটা এমন ভয়ংকর নিষ্ঠুরভাবে বাস্তবায়ন করেন? টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের তল্লাশি চৌকিতে অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা পুলিশের গুলিতে নিহত হন ২০২০ সালের ৩১ জুলাই। টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয় এই হত্যা মামলায়। ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছিল। তখন পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত পুরো কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রায় দেড় হাজার জনকে বদলি করা হয়েছিল।

বিচার হয়েছে, সবাই স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে রাশেদ সিনহা একজন মর্যাদাবান সাবেক সেনা কর্মকর্তা না হয়ে অতি সাধারণ নাগরিক হলে আজ হয়তো প্রদীপ আর লিয়াকতকে আমরা ভিন্ন মর্যাদায় দেখতাম। তার সহকর্মীরা, সাবেক কর্মকর্তারা প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদ উঠেছে সমাজের  নানা স্তর থেকে। ফলে কক্সবাজার ছুটে গেছেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান, যেতে হয়েছে পুলিশের প্রধানকেও। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে কক্সবাজারের নাগরিক সমাজ থেকেও। মামলা করেন সিনহার বোন। এবং শেষ পর্যন্ত ২৯ কার্য দিবসে মামলার রায় হয়।

ওসি প্রদীপ নিজেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নায়ক বানিয়েছিলেন। হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা, যখন তখন যাকে তাকে ধরে এনে নির্যাতন করা, এমনকি লুটপাট ও ডাকাতির মতো ঘটনায়ও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এখন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। একটা মানুষ কতটা নির্মমতার রাজত্ব কায়েম করলে হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ রায়ের দিন আদালতের বাইরে প্রদীপের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করতে পারেন?

সিনহার পরিবারকে ধন্যবাদ যে তারা লেগে ছিলেন মামলাটি এগিয়ে নিতে। আইনজীবী, বিশেষ করে পাবলিক প্রসিকিউটর, র‌্যাব, পুলিশ, নাগরিক সমাজ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের সুস্পষ্ট ভূমিকায় বিচারটি হয়েছে। এ কারণে সবাই ধন্যবাদ পাবেন।

ব্যক্তির দায় পুরো বাহিনীকে দেওয়া যায় না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রদীপের এতসব কাণ্ড যা এখন মানুষ জানতে পারলেন, সেটা কি তার ওপরের স্তরের কর্তাব্যক্তিরা জানতেন না? জানলে কেন তাকে নিবৃত্ত করা হয়নি? তার এবং লিয়াকতের আচরণ একদম পেশাদার অপরাধীর মতো। মেজর সিনহাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, পড়ে থাকা মানুষটাকে লাথি মারা হয়েছে, অশ্রাব্য গালি দেওয়া হয়েছে। অথচ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে বাঁচানো যেতো।

উল্টো এই ঘটনায় প্রথমে পুলিশ টেকনাফ থানায় দু’টি এবং রামু থানায় একটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং মাদক আইনে মামলা করেছিল। পুলিশের সেই মামলাগুলোতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম ও শিপ্রা দেবনাথকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। একটা বাহিনীর সদস্যের প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে কথা আসে যখন আমরা দেখি এরা প্রথমে চেষ্টা করেছে সিনহার সহযোগী শিপ্রার চরিত্র হনন করতে। তার ল্যাপটপ জব্দ করে সেখান থেকে ছবি নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সিনহার গাড়িতে মাদক রেখে ভুয়া জব্দ তালিকা তৈরি করেছিল। খুনের পাশাপাশি এগুলোও কম বড় অপরাধ নয়, যেটা নিয়ে পুরো বাহিনীকে ভাবতে হবে। সদস্যদের মোটিভেশনে, ওরিয়েন্টেশনে সমস্যা কোথায় সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। ভাবা দরকার, কেন সিলেটের বন্দর বাজার ফাঁড়ির এসআই আকবর দশ হাজার টাকার জন্য একটি তরুণ ছেলের জীবন কেড়ে নেয় মারতে মারতে।

করোনার সময় আমরা মানবিক পুলিশ দেখেছি, সেটাই আমাদের চাওয়া। আবার এ কথাও ঠিক যে নিয়মিত অপরাধী আর উচ্ছৃঙ্খল মানুষকে মোকাবিলা করতে করতে সবসময় আচরণ ঠিক রাখা যায় না। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা, হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা, নিরপরাধ মানুষের কাছে মাদক ঢুকিয়ে তাকে হয়রানি করার মতো কাজগুলো কোনও অবস্থাতেই ছাড় পাওয়া উচিত নয়।

বর্তমান সরকারের আমলে ১৩ বছরে পুলিশের কল্যাণে অনেক কিছু হয়েছে। এসবের অনুপ্রেরণা প্রধানমন্ত্রী। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবেই বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক পরিসরেও সেটা আলোচিত। এবং একথাও সত্যি যে পুলিশ আছে এবং থাকবে। পুলিশ মানুষের বাড়ি, গাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আর তাই পুলিশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা কারও কাজ নয়।

কিন্তু নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম থেকে যখন কিছু পর্যবেক্ষণ আসে, সেগুলো গুরুত্ব দিতে হয়। শিশু, নারী সর্বোপরি নাগরিকের নাগরিক মর্যাদার প্রতি পুলিশের সংবেদনশীলতা অনেক বেশি প্রত্যাশিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর হলে নাগরিকরাও তৎপর হয়। আক্রান্তের পাশে দাঁড়ালে মানুষ প্রশংসা করে। একটা পুলিশ-নাগরিক সংহতির পরিবেশ ছাড়া কি সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব?

লেখক: সাংবাদিক