সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ ও অধস্তন আদালত

মো. জে. আর. খান রবিনসংবিধান একটি দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। শাসকের ক্ষমতা বর্ণনা করে, শাসিতের মৌলিক অধিকার বর্ণনা করে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং শাসক তার ক্ষমতার গণ্ডি লঙ্ঘন করে শাসিতের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে তার প্রতিবিধানের জন্য বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনও আইন যদি এ সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।

অন্যদিকে সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনও বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হবে। এছাড়াও উচ্চ আদালতের রায় সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন বটে। তা সত্ত্বেও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণ হিসেবে
দু’একটি মামলার কথা উল্লেখ করা সমীচীন।

প্রথমত, একটি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির  মামলার প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ‘একজন মহিলা আসামির পরিত্যক্ত ও উন্মুক্ত গোয়ালঘর থেকে ১০৮ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। যা ওই আসামি নিজ হাতে বের করে দিয়েছে মর্মে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। তার একটি ছোট কন্যাসন্তান রয়েছে।’

পুলিশ প্রতিবেদন অনুযায়ী  তার  Previous Conviction and Previous Record [পূর্বোক্ত সাজা ও পূর্বোক্ত ইতিহাস (পি.সি & পি.আর)] শূন্য অর্থাৎ ইতিপূর্বে উক্ত আসামি অন্য কোনও ফৌজদারি মামলার আসামি হননি।

এ মামলায় জব্দ তালিকার সাক্ষীরা আলামত উদ্ধার হতে না দেখলেও বিচারিক আদালত পুলিশ সাক্ষীর বক্তব্য আমলে নিয়ে ১৯৯০ সালের  মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ  আইনের ১৯(১) ধারার  ৩(খ) সারণি মোতাবেক উক্ত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেছেন। কিন্তু ঘটনাস্থল একটি উন্মুক্ত ও পরিত্যক্ত স্থান, তাছাড়া সাক্ষ্য আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী আসামির আগের ভালো চারিত্রিক  ইতিহাস  প্রাসঙ্গিক হলেও এ মামলায়  বিচারিক আদালত উক্ত ব্যাপারে কিছুই বিবেচনা করেননি। এছাড়াও আসামি একজন মহিলা হিসেবে তার সামাজিক অবস্থান এবং শিশুকন্যার ভবিষ্যতের কথাও বিচারিক আদালত কোনও বিবেচনায় নেননি।

যেহেতু ফেনসিডিল বিক্রির উদ্দেশ্যে হেফাজতে রাখার অপরাধে উক্ত আসামিকে সাজা প্রদান করা হয়েছে এবং অন্যান্য আসামিকেও ভিন্ন ভিন্ন মামলায় বিচারিক আদালত প্রতিনিয়ত একই ধরনের সাজা  প্রদান করে যাচ্ছেন। সেহেতু ফেনসিডিল সম্পর্কে সম্যক ধারণা একান্ত আবশ্যক।

নয়াদিল্লির ডা. শাকশি শর্মা বিগত ১৯-০৫-২০২১ইং তারিখে তাঁর লেখা একটি আর্টিক্যালে উল্লেখ করেছেন, ‘ফেনসিডিল সিরাপ হলো একটি সমন্বয়ক ওষুধ, যা কফের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি নাকের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, বাতাসনল এবং  ফুসফুসের মধ্যে কফ সরাতে সাহায্য করে।’ এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, বমি, মুখের মধ্যে শুষ্কতা, পেটে অস্বস্তি, মাথা ব্যথা, কাশি, এবং ক্লান্তি’। এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অধিকাংশই অস্থায়ী এবং নির্দিষ্ট সময়ে তা ঠিক হয়ে যায়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ফেনসিডিল সেবন নিষেধ করেছেন তিনি।

এবার মূল কথায় আসা যাক। তর্কের খাতিরে যদি উক্ত মামলার ঘটনা সত্য হিসেবে বিবেচনা করি,তাহলে এক্ষেত্রে  বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক মো. আকরাম হোসেন বনাম রাষ্ট্র [১৭ এম,এল, আর (আ.বি.) ৩৯৯] মামলায় প্রদত্ত  রায় খুবই প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচ্য। উক্ত মামলায় আপিল বিভাগ উল্লেখ করেন যে ‘ফেনসিডিল নিষিদ্ধের আইন বিদ্যমান না থাকলেও  ফেনসিডিলে ক্লোরফেনিরামিন ম্যালিয়েট বা কোডিন ফসফেটের উপস্থিতি মাদকের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধা নেই। উভয় উপাদানই ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯(৩) ধারা অনুযায়ী অনুমোদন যোগ্য এবং ১১৮ বোতল ফেনসিডিলে খুবই নগণ্য মাদক রয়েছে,  তাই এক্ষেত্রে ১৯৯০ সালের  মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯(১) ধারার সারণি ৩(খ)-এর পরিবর্তে উক্ত ধারার (৩ক) সারণি অনুযায়ী অপরাধ বিবেচনা করে যাবজ্জীবন সাজার পরিবর্তে ন্যূনতম সাজা নির্ধারণ করেছেন। উল্লেখ্য, মাদকের পরিমাণ ২ কেজির ঊর্ধ্বে হলে সারণি ৩(খ) অনুযায়ী  সাজার পরিমাণ যাবজ্জীবন এবং মাদকের পরিমাণ ২ কেজির কম হলে সারণি ৩(ক) অনুযায়ী  সাজার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং সর্বনিম্ন ২ বছর। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক লেনদেন দেওয়ানি বিরোধ বিধায় দেওয়ানি অধিক্ষেত্রের আদালত কর্তৃক বিচার্য, ফৌজদারি অধিক্ষেত্রের আদালত কর্তৃক বিচার্য নয় মর্মে আপিল বিভাগ সৈয়দ আলী মীর এবং অন্যান্য বনাম সৈয়দ ওমর আলী এবং অন্যান্য [১০ বি,এল,ডি(আ.বি.)১৬৮] মামলায় উল্লেখ করলেও ব্যবসায়িক লেনদেন  নিয়ে উদ্ভবকৃত দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারার  অন্য একটি মামলায় চার্জ শুনানির সময় বিচারিক আদালত তা বিবেচনায় না নিয়ে আসামির বিরুদ্ধে  চার্জ গঠন করছেন। তৃতীয়ত, মো. নূর হোসাইন বনাম মো. আলমগীর আলম [৩৭ বি,এল,ডি (আ.বি.)২০২] মামলায় আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন, চেক গ্রহীতা ও চেকের প্রকৃত ধারক ব্যতীত অন্য কেউ মামলা করলে তা হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১-এর ১৩৮ ও ১৪১ ধারা অনুযায়ী আইনে রক্ষণীয় নয়। কিন্তু একই রকম মামলায় চার্জ শুনানিতে বিচারিক আদালত উচ্চ আদালতের উক্ত সিদ্ধান্ত আমলে না নিয়ে আসামির বিরুদ্ধে  চার্জ গঠন করেছে। এরকম আরও অসংখ্য নজির রয়েছে। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলতে পারি অধস্তন বিচারিক আদালত কোনও কোনও ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি উদাসীন মনোভাব পোষণ করে আসছেন। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আশার কথা হলো, অধস্তন বিচারিক আদালতের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আসামি কর্তৃক দায়েরকৃত আপিলের গ্রহণযোগ্যতা শুনানির সময় হাইকোর্ট বিভাগ আলোচ্য বিষয়সমূহ আমলে নিয়ে আসামির জামিন মঞ্জুর করেছেন। অন্যদিকে অপর  দুই মামলার ক্ষেত্রেও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১-এ ধারা মোতাবেক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন।

পরিশেষে এটুকু বলা যায়, একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের শাসন একান্ত আবশ্যক এবং সে লক্ষ্যে বিচার বিভাগ অক্লান্ত পরিশ্রম ও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে অধস্তন আদালত  উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত যথাযথ প্রতিপালন করলে  মামলার আধিক্য ও মানুষের হয়রানি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। তাই উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি অধস্তন আদালতের সম্মান প্রদর্শন করাই যুক্তিযুক্ত।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট