বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের আলো ছড়ায় নাকি নিজেই অন্ধকারে নিপতিত হয়?  

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাগোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আবারও শিরোনামে। এবার আরও জঘন্য ঘটনা। ছাত্রীকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। গত বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও এক ছাত্রী গোপালগ‌ঞ্জ শহরের হেলিপ্যাড থেকে নবীনবাগের দিকে ফিরছিলেন। এ সময় চার থেকে পাঁচ জন দুর্বৃত্ত তাদের গতিরোধ করেন। ছাত্রকে মারপিট করে ওই ছাত্রীকে পাশের নির্মাণাধীন জেলা প্রশাসন স্কুল ও কলেজ ভবনে নিয়ে ধর্ষণ করে তারা।

রাতে ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছালে শিক্ষার্থীরা গোপালগঞ্জ থানা ঘেরাও করেন। শিক্ষকরাও যোগ দেয় প্রতিবাদে। কিন্তু ধর্ষকরা এতটাই শক্তিশালী যে তারা প্রতিবাদরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে, তাদের বেধড়ক পেটায়, রাস্তায় আবর্জনা ফেলে নিজেদের অপকর্মের পক্ষে অবস্থান নেয়। দুর্বৃত্তরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টরসহ কমপক্ষে ২০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে আহত করেছে।

এর আগে ২০১৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে অনভিপ্রেত আচরণের জন্য আন্দোলনের মুখে উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনকে রাতের আঁধারে পুলিশি পাহারায় পালিয়ে যেতে হয়েছিল।

ঢাকার বাইরের জেলায় প্রান্তিক এলাকায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। স্থানীয় জনগণকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে সরকারের উদ্যোগ কতটা কাজ লাগছে সেটা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই এলাকায় কতটা জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারছে, আর কতটা নিজেরাই অন্ধকারের শক্তির আক্রমণে পড়ছে তার একটা হিসাব করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের হলে জায়গা হয় না, তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করতে হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থা আমরা চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখেছি। যেখানে আশপাশের গ্রামে ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র শক্ত ঘাঁটি গড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা খোদ বিশ্ববিদ্যালয়কেই জিম্মি করে আতঙ্কের মধ্যে রাখতো একসময়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটায় শিক্ষক কাঁচি নিয়ে ছোটেন ছাত্রদের চুল কাটতে, কোনোটায় উপাচার্য তার পরিবারের সবাইকে শিক্ষক বা অফিসার বানিয়ে ফেলেন, কেউ ঢাকায় বসে রিমোট কন্ট্রোলে ক্যাম্পাস পরিচালনা করেন।

এখন যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে সেখানে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে ছাত্রী ও শিক্ষিকারা। তারা অনিরাপদ শুধু এ কারণে না যে তারা ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার। রাস্তায় বের হলে নিয়মিত তাদের শুনতে হয় কে কাপড় মাথায় দিয়েছে, কে দেয়নি, ওড়না আছে কি নেই- এই জাতীয় সব ইভ টিজিং। এসব উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েদের নিগ্রহ হওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। খুব কমই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। মুখ বুজে অত্যাচার হজম করা বা নীরবে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগের অনেক ঘটনাই ঘটছে। এর কারণ অতি অসুরক্ষিত ক্যাম্পাস এবং আশপাশের রাজনৈতিক ও অসামাজিক শক্তির অমিত ক্ষমতা। পাশাপাশি দায়ী পারিপার্শ্বিক চাপ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই দোষ দেওয়া হয়। যেকোনও ঘটনা হলেই শুরু হয় রাজনৈতিক চাপ, কুৎসিত ট্রল। প্রতিবাদকারীদের ন্যায্য আন্দোলনকে রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করা হয়। ফলে সাহস করে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও নানা চাপের মুখে একটা বড় অংশ মাঝপথে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

মন্ত্রী, এমপি, আমলা বা প্রভাবশালীরা নিজ নিজ এলাকায় একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাগিয়ে স্থানীয় মানুষের বাহবা পাচ্ছেন। কিন্তু এগুলোতে সুস্থ, স্বাভাবিক জ্ঞানের চর্চা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা, উদারতার চর্চা কতটুকু হচ্ছে সে নিয়ে কোনও ভাবনা নেই। ভাবলে এগুলোর দিকে তাদের নজর পড়ার কথা ছিল।      

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। মাত্রই কিছুটা স্তিমিত হয়েছে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন। ক্যাম্পাসের পরিবেশ কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কতটা অসংবেদনশীল, তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

কাজের পরিবেশ নেই, জানার পরিবেশ নেই, ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চা নেই, মুক্তমতের জায়গা নেই এবং অবকাঠামোও সেভাবে নেই। বেশিরভাগের একটি নির্মোহ মূল্যায়ন করলে মনে হবে এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না করলে ভালো হতো। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা যায় না, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে হয়। নতুনগুলো তো হলোই না, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের মর্যাদা হারিয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাটাই আজ উপেক্ষিত, শিক্ষার পরিবেশে ভয়ানক দুর্দশা চলছে।

একমাত্র ঠিকমতো চলছে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। কিন্তু সেটাও একদিকের। যখন যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে, আধিপত্য কেবল তাদের সমর্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা থেকে সাউন্ড গ্রেনেডের হামলা সইতে হলো। অপরাধ একটাই, তারা কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, কিছু অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিল। উপাচার্য ভাবলেন না বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রশ্ন করতেই শেখায়। ক্যাম্পাস মানে আলোচনা, যুক্তি-প্রতিযুক্তি।

ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ। তার বিচার হতেই হবে। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে অন্য ভাবনাও ভাবতে হবে। এগুলোর শিক্ষার্থীরা স্থানীয় সমাজের কিছু মানুষজনের কাছ থেকে নিয়মিত বৈরিতার মুখে পড়ছেন। এসব বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের ভাবা দরকার। কীভাবে সমাজে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায় সে বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো উচিত।

লেখক: সাংবাদিক