করোনার আতঙ্ক ছাপিয়ে দুই বছর পর এবার প্রথম কোনও বিধিনিষেধ ছাড়াই ঈদে ঘরমুখো হয়েছেন শহরে বাস করা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। কী যে এক দুঃসহ জীবন পার করতে হয়েছে। প্রকাশ্যে ঈদের আনন্দ করতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। কোলাকুলিও ছিল নিষিদ্ধ। প্রিয়জন অথবা পরিচিত কাউকে দেখলেই আমরা সৌজন্যতা প্রকাশের জন্য হাত বাড়িয়ে দেই। কেমন আছেন বলে অন্তরের মায়া ছড়িয়ে দেই। অথচ করোনাকালে নিজের হাতের প্রতিও বিশ্বাস রাখা যায়নি। হাত নাকি বিষ ছড়ায়। সে কারণে প্রিয়জনের সঙ্গে হাত মিলাইনি বহুদিন। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের ওপর দয়া করেছেন। করোনার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় এবার শুধু পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলানো নয়, ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলিও করতে পারবো। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি আমরা। এজন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ঈদ আমাদের দেশে সর্ব প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সে কারণে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে হলেও সবাই পরিবারের সঙ্গেই একত্রিত হতে চায়। এজন্য সারা বছরের অপেক্ষা থাকে। অনেকে এ জন্য টাকা জমায়। আর্থিক কষ্টের মধ্যেও নতুন জামা-কাপড় কিনে পরিবারের সবার জন্য। বাবার পাঞ্জাবি, মায়ের শাড়ি, বোনের জন্য সালোয়ার কামিজ, স্ত্রী, সন্তানের জন্য শাড়ি, ঈদের পোশাক কেনার মধ্যেই আনন্দ খোঁজে। এটাই বাঙালি মুসলমান পরিবারের হাজার বছরের সংস্কৃতি। এই ডিজিটাল যুগে এটি যেন নতুন রূপ পেয়েছে। আগেকার দিনে দর্জি বাড়ি গিয়ে নতুন কাপড়ে বানানোর অর্ডার দিতে হতো। শাড়ি বাদে সব ধরনের পোশাকই বানিয়ে দিতো দর্জি। আর এখন দর্জি বাড়ি না গেলেও চলে। বিভিন্ন মার্কেটের দোকানে দোকানে রয়েছে মন পছন্দের রেডিমেড পোশাক। মার্কেটে যেতে মন চাইছে না তাহলে ঘরে বসেও নতুন পোশাকের অর্ডার করা যায়। চাহিদা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাবে নতুন পোশাক। ঈদে নতুন পোশাকের পাশাপাশি ভালো খাবারের আকর্ষণ থাকে বেশি। এজন্য গৃহিণীদের সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। ডিজিটাল যুগে এটাও সহজ হয়ে গেছে। অনলাইনে অর্ডার করলেই হাজির হবে ধোয়া উড়ানো গরম খাবার। আর কী চান আপনি? নিজের হাতে খাবার মুখে তুলে দিতে চান না এই তো? আশা করি আপনার এই আকাঙ্ক্ষাও পূর্ণ হবে একদিন। নিজের হাতে খাবার খেতে হবে না। রোবটরূপী মানুষই হয়তো আপনার মুখে খাবার তুলে দেবে। তবে সেটা মানুষের জন্য কতটা কল্যাণকর হবে এটাই বড় প্রশ্ন।
ঈদ উপলক্ষে ব্যস্ত ঢাকা শহর অতিমাত্রায় শান্ত হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহর বলতে গেলে এখন অনেকটাই ফাঁকা। দুই দিন আগে যে জায়গায় যেতে সময় লেগেছে এক থেকে দেড়ঘণ্টা। সেই জায়গায় যেতে এখন সময় লাগছে সর্বোচ্চ পনের মিনিট। অবাক ব্যাপার না? পনের মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগে দেড়ঘণ্টা। সময় নষ্ট। মানুষের প্রতিদিনের শ্রমঘণ্টার অপচয়। আরও কত সংকট নিয়ে দিন পার করে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর। আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ বাস করে এই শহরে। নানান প্রক্রিয়ায় জীবনযুদ্ধে লিপ্ত সবাই। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, গভীর রাত বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই ছুটছে মানুষ। কেন? জীবনযুদ্ধে জেতার জন্য। সেই মানুষগুলোই ঈদে ছুটে গেছে গ্রামে। নাড়ির টানে। শেকড়ের সন্ধানে। এজন্য বেশি দামে ট্রেন, বাস, আকাশ পথের টিকিট কিনতে হয়েছে। কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের একটি টিকিট পাওয়ার আশায় সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়েছে শত শত মানুষ। বাসের টিকিট পেতে কী যে প্রাণান্তকর চেষ্টা। ট্রেনে বসার সিট না পেয়ে শত শত যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি ফিরেছে। কমলাপুর স্টেশনে নীলসাগর ট্রেনের একটি বগিতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় দেখে একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম– ‘এত কষ্ট করে বাড়ি যাবেন? ভদ্রলোক ট্রেনে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছেন না। দুইধারে অন্য যাত্রীর কনুইয়ের গুঁতো খাচ্ছেন বারবার। তবু মুখে প্রশান্তির হাসি। বললেন, এই কষ্টের মধ্যেও আনন্দ আছে ভাই। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা আছে। তাদের হাসিমুখটা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম– আজকাল মোবাইলের ভিডিও কলেও তো যখন তখন শুধু বাবা-মা কেন, প্রিয়জন সকলের মুখ দেখার সুযোগ আছে। তারপরও কেন এত কষ্ট...? ভদ্রলোক তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন এভাবে– দুধের স্বাদ কী ভাই ঘোলে মিটানো যায়? ভিডিও কলে মানুষ মানুষকে দেখে। কিন্তু ছুঁতে পারে না। বাবা-মাকে ছুঁয়ে দেখার জন্যই এত কষ্ট করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ভদ্রলোকের এই অন্তর ছোঁয়া কথা শুনে মনে একটা প্রশ্নই উঁকি দিল। ঈদযাত্রায় মানুষের এই যে ভোগান্তি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে তার কি কোনও শেষ নাই? পরক্ষণেই মনে হলো সোয়া কোটি মানুষের কথা। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ঢাকা শহরে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও আকাশ পথে গড়ে ১৫ লাখ মানুষ আসা যাওয়া করে। সেখানে হঠাৎ করেই যদি সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩০/৩৫ লাখ তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। এজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন।
রেলপথ ও সড়কপথেই সাধারণ মানুষ বেশি যাতায়াত করে। কাজেই উভয় পথের যাতায়াত ব্যবস্থার আধুনিকীকায়ন জরুরি। উন্নত দেশে দূরের যাত্রার ক্ষেত্রে রাস্তায় এক লেনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ একটি রাস্তায় দুটি লেন। একটি যাওয়ার অন্যটি আসার। শহর অতিক্রম করার সময় উড়াল সড়ক ব্যবহার করা হয়। ফলে কেউ কারও জন্য দাঁড়ায় না। অত্যধিক জনসংখ্যাকে আমাদের দেশে যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ উন্নত সড়ক ব্যবস্থা চালু করা গেলে জনসংখ্যা কোনও সমস্যা হবার কথা নয়।
নাড়ির টানে বাড়ি গেছে সবাই। শহরের আনন্দ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো আপনি কি এই আনন্দ শুধু নিজে উপভোগ করবেন, নাকি অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন? আপনি শহরে থাকেন, ভালো চাকরি করেন, আপনার অনেক নাম-ডাক। সঙ্গত কারণেই গ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে আপনার ওপর। এই আগ্রহটাকেই আপনি পজিটিভ অর্থে ব্যবহার করতে পারেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামে গেছেন, গ্রামের মেধাবী তরুণদের ডেকে একটা আড্ডার ব্যবস্থা করুন না। আপনার জীবনের সাফল্য তাদের মাঝে তুলে ধরুন। ভালো বই পড়তে উৎসাহ দিন, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত হবার কথা বলুন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের মন্ত্র শিখিয়ে দিন, পাঠাগার গড়তে বলুন। দেখবেন তরুণরা আপনার কথায় উৎসাহিত হবে।
একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। পাঁচ বছর আগের কথা। কুড়িগ্রাম জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আব্দুল মজিদের বাড়ি। ঢাকায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় পদে চাকরি করেন। ভালো ছাত্র হিসেবে গ্রামে তার ব্যাপক পরিচিতি। এক ঈদে গ্রামে বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছিলেন আব্দুল মজিদ। একদিন এলাকার তরুণ ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে স্রেফ আড্ডা দিলেন। কে কী করে, ভবিষ্যতে কী হতে চায় জানতে চাইলেন। দেখা গেলো সবার ভবিষ্যৎ ইচ্ছে চাকরি করবে। আব্দুল মজিদ তাদের অনেক বুঝালেন। স্বাবলম্বী হবার গল্প বললেন। পরের বছর দেখা গেলো ওই এলাকায় একটি পাঠাগার হয়েছে। হাঁস মুরগির খামার হয়েছে, একটি ক্লাবঘরও গড়ে উঠেছে। যেখানে বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমে গেছে।
কাজেই ঈদের এই আনন্দের মুহূর্তে আপনিও আপনার অবস্থানে দাঁড়িয়ে সমাজ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। আর কিছু না হোক এলাকার একজন গরিব মেধাবী ছাত্র অথবা ছাত্রীকে এককালীন আর্থিক সাহায্য করতে পারেন। নিজের বসতবাড়িতে ফলদ অথবা ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন। ভেবে দেখুন তো প্রতি ঈদে আপনি যদি এভাবে নতুন গাছের চারা লাগাতে পারেন তাহলে একদিন পরিবেশটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সবুজে ছেয়ে যাবে আপনার বসতবাড়ি। সবুজ মানেই প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। সবুজ মানেই আনন্দময় জীবন। সবুজ মানেই আগামীর সুন্দর পৃথিবী। কাজেই সবুজ পৃথিবীর জন্য গাছ লাগানো অনেক জরুরি।
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই বিনোদন। ঈদে টেলিভিশন অনুষ্ঠান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবারের ঈদেও দেশের প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল ৭ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। কাজেই এই ঈদে আমাদের উচিত দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। এমনও দেখা যায় ঈদের দিনেও অনেকে ভিন দেশের টেলিভিশন চ্যানেল চালু রাখেন। টেলিভিশনে আপনি কী দেখবেন কী দেখবেন না এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরিই আপনার। তাই বলে দেশকে গুরুত্ব দেবেন না এটা কি ঠিক?
ও হ্যাঁ, ঈদে প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া পবিত্র দায়িত্ব। বিশেষ করে গরিব প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াবেন। মনে অনেক আনন্দ পাবেন। ঈদ হোক অনেক আশার এবং ভালোবাসার... এবারের ঈদ সবার জন্য শুভ হোক।
প্রিয় পাঠক ঈদ মোবারক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।