৬ টাকা ৫৫ পয়সা বরাদ্দে মানুষ যখন বন্যায় ভাসছিল

ডুবছে মানুষ, ভাসছে মানুষ, ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, ম্যাচ আর মোমবাতি পর্যন্ত নেই, আছে কেবল থইথই পানি। একতলা বাড়িগুলো সব পানির নিচে। এত পানি চারদিকে, কেবল পানযোগ্য পানি নেই একফোঁটা। সব টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে।

বলছি কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা এবং সিলেট বিভাগের ভয়াবহ বন্যার কথা। এমন ভয়াবহ, বীভৎস সব ভাসিয়ে নেওয়া বন্যার কথা বহুকাল শোনেনি এ দেশের মানুষ। বলা হয় ৮৮ সালের পর এমন সর্বগ্রাসী বন্যা আর হয়নি এ দেশে। ১২২ বছরের মধ্যে এমন বৃষ্টিও নাকি দেখেননি চেরাপুঞ্জির মানুষ।  

এবার বিশেষ করে সিলেট এবং সুনামগঞ্জে ভয়ংকর বন্যায় মানুষ যে মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন, সেটা নজিরবিহীন। খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ পানিতে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট জেলার প্রায় পুরোটা তলিয়ে যাওয়া উদ্ধার কাজকে চরম বাধাগ্রস্ত করছে। কিন্তু এটা ঘটেছে সরকারের সুস্পষ্ট অবহেলার কারণে। এই মাসের মাঝামাঝি সিলেটে যে একটা ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে, সেটা নিয়ে স্পষ্ট পূর্বাভাস ছিল।

এ বিষয়ে গত ১৮ জুন দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল বলেন– ‘আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো ১০ থেকে ১৬ দিন আগেই সিলেট বিভাগ ও ভারতের মেঘালয় পর্বতের ওপর প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা নির্দেশ করেছিল। জুন মাসের ৫ ও ১২ তারিখে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সাপ্তাহিক কৃষি সংবাদে আমার দুটি সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্টত করে উল্লেখ করেছিলাম জুন মাসের ১৫ তারিখের পরে সিলেট বিভাগে সম্ভাব্য বন্যার কথা’।

সেটাই না, সিলেট ডুবে যাবার কয়েক দিন আগে ভারতের আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং এর ফলে সৃষ্ট বন্যার কথা ভারত এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেই এসেছে। সবকিছু এত স্পষ্টভাবে জানার পর দেশের আবহাওয়া বিভাগ আর দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কী করেছে?

এখন নানা এলাকা থেকে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সম্ভাব্য দুর্যোগ অনুমান করে মানুষকে তো আগেই আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার কথা ছিল। বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন এবং মোবাইল নেটওয়ার্কহীন হয়ে গেছে। পাওয়া যাচ্ছে না দেশলাই, মোমবাতিও। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে তো পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়ার কথা ছিল না। প্রথম আলোর রিপোর্ট বলছে ত্রাণের আশায় রাস্তায় শত শত মানুষ। এমনকি সামান্য কিছু ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত হয়েছে, এমনকি মারাও গেছে মানুষ। উন্নয়নের মহাসোপানে ওঠা বাংলাদেশের এই হলো বর্তমান চিত্র।  

সরকারের এই প্রস্তুতিহীনতার কারণে এখন আমরা খাবার, মোমবাতি, নৌকা ভাড়া এবং নৌকার দাম শত থেকে হাজারগুণ বেশি হাঁকতে দেখছি অনেককে। তাদের আর দোষ কী? যে দেশের মানুষরা দেখে সরকারি কেনাকাটায় একটা বালিশের দাম ৬০০০ টাকা, বই ৮৫০০০ টাকা, পর্দা ৩৭ লাখ টাকা, টেলিফোন ১৫ লাখ টাকা, ব্লাডপ্রেসার মেশিন ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা, টেবিল ১২ লাখ টাকা, চেয়ার ৬ লাখ টাকা, একটা বঁটি ১০ হাজার টাকা, সেই দেশের কিছু মানুষ সেসব তো শিখতেই পারে। বিপদে মানুষকে জিম্মি করাতো একটা সংস্কৃতি, যার সাথে মজ্জায়, মগজে অভ্যস্ত হচ্ছি আমরা।

তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম এখন পানি অনেক বেড়ে যাবার কারণে এসব মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে সরকার সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষরা কেমন আছে? মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তো সরকারের। অথচ আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষদের খাদ্যের চরম সংকটের সংবাদে মিডিয়া সয়লাব হয়ে আছে। জানা যায়, সিলেট এবং সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত এলাকার ৫০ লাখ মানুষের জন্য সরকারের প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ৬০ লাখ টাকা। এতে মাথাপিছু এই অঙ্ক হচ্ছে এক টাকা ২০ পয়সা। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি হিসাবে সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল ও প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বন্যাকবলিত ৪৪ লাখ মানুষের বিপরীতে জনপ্রতি বরাদ্দ দাঁড়ায় ৬ টাকা ৫৫ পয়সা ও ৪৪০ গ্রাম চাল।

আমার মনে পড়ে গেলো করোনার শুরুর দিকে লকডাউনের সময় মানুষকে সরাসরি যে খাদ্য এবং আর্থিক সাহায্য করেছিল সরকার, সেটার কথা।

সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী তখন তিন মাসে একজন মানুষ গড়ে চাল পেয়েছিলেন ২.৬২ কেজি। প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪.৫৫ গ্রাম। তিন মাসে একজন মানুষ গড়ে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন ২০.৫৮ টাকা। প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১.৩৮ পয়সা। হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্পে অতি উৎসাহী সরকার কেন যেন সাধারণ মানুষের দুর্গতিতে অসহায় হয়ে পড়ে। তখন আর সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া হওয়া সরকারের সক্ষমতার ন্যূনতম কোনও নমুনা দেখতে পাই না আমরা। আর তাই অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ২ কেজি চিড়ায় তিন দিন কাটাতে হয় সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের কৃষক মানিক মিয়াকে, যার ঘর তলিয়ে গেছে ৪-৫ ফিট পানির নিচে, যার ১৬ মণ ধান স্রেফ নাই হয়ে গেছে এই বন্যায়।

এখন থেকে ঠিক এক মাস আগে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা হয়েছিল। তখনকার পত্রিকাতেও ত্রাণের অভাবের কথা নিয়মিত এসেছে। এমনকি তখন প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ ১২০ জন মানুষকে ত্রাণ তুলে দিয়ে ফটোসেশন করতে যাবার পর সেখানে থাকা শত শত বন্যাদুর্গত ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণ নিয়ে হুড়োহুড়ি করে। তাদের ভাগ্যে ত্রাণ আর জোটেনি শেষ পর্যন্ত, জুটেছে পুলিশের বেদম পিটুনি। এই যেমন দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও এক ছটাক চালও জোটেনি সিলেট সদর উপজেলার বাম হাত হারানো জমশেদ আলীর।

এরমধ্যেই বিরোধী দল বলছে- ‘ফারাক্কার সব বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে, এই বাঁধ দিয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা সব নদীর পানি বাড়তে থাকবে।’ এমন যদি হয় তাহলে দেশের মানুষকে ভাসিয়ে দেবে, তাদের কষ্টের ফসল নষ্ট করবে, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু নষ্ট করবে, তাদের যা কিছু আছে, যেটুকুই আছে, তার সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গত একযুগেও ভারতের সাথে অভিন্ন ৫৪ টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি আমরা করতে পারিনি। বহু বছর তিস্তার 'মুলা' দেখলাম আমরা। ফারাক্কা বা টিপাইমুখ হঠাৎ খুলে দেয় তারা, ভাসে বাংলাদেশ, ভাসে বাংলাদেশের মানুষ। এজন্য সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সরাসরি দায়ী।  

প্রতিবারের দুর্যোগের মতো সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। সেসব মানুষ নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আরও একটি কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য, আর তা হলো- দেশের প্রাকৃতিক কিংবা কোনও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে দুর্গত মানুষকে সব রকম সাহায্য দেওয়ার দায়িত্ব শুধু সরকারের। সরকার কতটুকু করে সেটা?

রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিল। সিলেট বিভাগ যখন বন্যায় ভাসছিল, ৫০ লাখ মানুষ যখন খাবার এবং সুপেয় পানির অভাবে হাহাকার করছিল, ঠিক তখনই বরিশাল বিভাগে চলছিল জয়বাংলা কনসার্ট। নাচে, গানে মেতেছিল মানুষ। সরকারি দলের এক অতি প্রভাবশালী এমপি চার্টার্ড বিমানে সেখানে গিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছেন। কনসার্টের নাচ-গান আরও বেশি আনন্দময় করার জন্য কেবল ভারতীয় শিল্পী মিমি চক্রবর্তীকেই কত টাকা খরচ করে আনা হয়েছে তার হিসাব কে রাখে? তবে তাতে কি? বানভাসি মানুষের জন্য বরাদ্দ তো দিয়েছে সরকার, মাথাপিছু ৬ টাকা ৫৫ পয়সা, সেটাই বা কম কোথায়?
 
 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।