‘হ্যালো, ওসি রমনা… শুনছেন মানুষ কী বলছে?’

‘হ্যালো! ওসি, রমনা থানা?’ ডায়ালগটি পরিচিত লাগছে? হুমায়ূন আহমেদের নাটক যারা দেখেন, তারা জানেন– কোন চরিত্রটি সমস্যায় পড়লে সাথে সাথে রমনা থানার ওসিকে ফোন করে। ফিকশান থেকে বাস্তবে এবার রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তুমুলভাবে আলোচিত হলেন।

 গত ৫ আগস্ট এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবরে মনিরুল ইসলাম নামের এই পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব (রিপোর্ট অনুযায়ী আংশিক) দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকায় আটতলা বাড়ি করেছেন তিনি। বানাচ্ছেন আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে তার রয়েছে চারটি প্লট। রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সরকারি একটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সেই পত্রিকার অনুসন্ধানে ওসি মনিরুলের এসব অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ সূত্র বলছে, যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তার সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি।

খবরটি পত্রিকার সর্বোচ্চ পঠিত, সেই সাথে আলোচিততেও যায়। অর্থাৎ পাঠক খবরটিকে যেকোনও কারণেই হোক গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। অর্থাৎ খবরটি ভীষণভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মানুষের। খবরটি নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ মানুষের আগ্রহ, না হলে এমন খবর তো খুব নতুন কিছু নয়। মানুষের আগ্রহের কারণ বোঝার জন্য গেলাম মন্তব্য পড়তে। যেকোনও লেখায় পাঠকের মন্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করে। যেহেতু রাজনীতি করি, তাই মানুষ নিয়েই আমার কাজ। মানুষের চিন্তা, মনোজগৎ এই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি, যার একটা ধারণা পাঠকের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়।

তাদের অনেকেই বলতে চাইছেন দুর্নীতি কে করে না, সেটাই এখন খবর হবার কথা। আসলেই তো তাই! পুলিশ, আমলা, সরকারি কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ ঘুষ, দুর্নীতির সাথে যুক্ত বহু আগে থেকেই। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেটি সকল সীমা অতিক্রম করেছে। তাই এই ওসি সাহেবের মাত্র কয়েকটি বাড়ি আর অল্প কিছু প্লটের খবর খানিকটা হতাশই করেছে মানুষকে।

এ দেশে দুর্নীতির টাকা বলতে এখন বোঝায় হাজার কোটি না হলেও অন্তত শত কোটি টাকা। মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, এ দেশে সরকারি চাকরি করা একজন মানুষও দুর্নীতির বাইরে না। দেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের হতাশা একদিনে তৈরি হয়নি, এ চিত্র নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এক বার্তা দেয়।

দেশে টাকা পাচারের বীভৎসতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বলছে, বছরে দেশ থেকে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার হয় কমপক্ষে ৭২ হাজার কোটি টাকা, নির্বাচনের আগে যার পরিমাণ বাড়ে আরও কয়েকগুণ। হুন্ডিতে পাচার হিসাব করলে এই অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, সুইস ব্যাংক, প্যারাডাইস বা পানামা পেপার্সের যে ফিরিস্তি আমাদের কাছে আসে সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বেখবর থাকলেও জানে দেশের মানুষ। আর তাই দেশের টাকা দেশেই আছে কেবল এটুকুই অনেকের কাছে অনেক বড় সান্ত্বনা। একটা দেশের অর্থনীতির জন্য টাকা পাচার কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ বাংলাদেশের আজকের অর্থনৈতিক অবস্থা।

রিপোর্টটি আমরা যারা পড়েছি তারা জানি, এই অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল সরকারি একটি সংস্থা। অসংখ্য মন্তব্যে পুলিশ বাহিনী তো বটেই, দেশের সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততা কোন তলানিতে পৌঁছেছে সেটি খুব স্পষ্ট। কিন্তু কেন আর সব পুলিশ সদস্য কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের বাদ দিয়ে একজন রমনা থানার ওসির ‘কুষ্ঠি-ঠিকুজি’ খোঁজার চেষ্টা হলো? মজার ব্যাপার, এর জবাবও চমৎকারভাবে দিয়েছেন একজন পাঠক। তিনি লিখেন– ‘ওসিরও দোষ নাই, বিপুল সম্পদেরও দোষ নাই, দোষ হচ্ছে কোথায় জানি ভাগবাটোয়ারায় মিল হচ্ছে না’।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের একেবারে দ্বিতীয়/তৃতীয় সারির কিছু নেতাকে ধরে তাদের দুর্নীতির কিছু তথ্য মানুষের সামনে এনে সরকারের দিক থেকে বলার চেষ্টা করা হয়েছিল, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাচ্ছে। সেই তথাকথিত অভিযানের একটা বেশ বাহারি নামও দিয়েছিল তারা– ‘শুদ্ধি অভিযান’। তখনই মানুষ প্রশ্ন করেছিল একেবারে চিহ্নিত অনেক রাঘব-বোয়ালদের বাদ দিয়ে ওসব চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে অভিযান কেন? তখনই কথা উঠেছিল, তারা আসলে শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোন্দলের, যেটা হয়েছিল ভাগবাটোয়ারায় সমস্যা থেকেই।  

ইদানীং ঝানু, বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ানরাও বলা শুরু করেছেন, আমলাদের দাপটে রাজনীতিবিদরা পুরোপুরিই কোণঠাসা। ‘আমলাদের দাপটের’ এই উৎস কী তা ভালোই জানেন দেশের মানুষ। এছাড়াও বিরোধী দল-মতের মানুষের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনের দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো আচরণ রাজনীতির মাঠে যথেষ্টই স্বস্তিতে রেখেছে সরকারকে।

মনে পড়ে গেলো তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় একটি প্রশ্ন বারবারই সামনে এসেছে। একজন সম্রাট বা জিকে শামিম অথবা একজন এনু কিংবা রুপন কি একাই তৈরি হয়? কারা তাদের তৈরি করে, মদত দেয়, হৃষ্টপুষ্ট করে নিজেদের স্বার্থে? কারা ব্যবহার করে তাদের? তারা যদি এই কয় বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারে তবে তাদের যারা তৈরি আর ব্যবহার করেছে, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা সেই রাঘব বোয়ালরা তবে কত টাকার মালিক?

সেই টাকার উৎস কী? আমাদের মতো দেশে সেই পেছনের কারিগরদের হাত অনেক লম্বা, তাদের বিচারের আওতায় আনবে সেই সাধ্য কার?

আমলাদের অপকর্ম, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে খবর প্রকাশের পরিণতি কী হয় আমাদের দেশে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। কেবল যে ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে তাদের হেনস্তা করা হয় তা-ই না, তাদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, ভয় দেখানো, সবই চলে এই দেশে। সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে শুরু করে মফস্বল শহরের ‘ত্যানাফাডা’ সাংবাদিক পর্যন্ত সকলকেই ভুগতে হয়েছে আমলাদের নিয়ে লেখার জন্য।

আচ্ছা, একজন মানুষের জীবনে কত টাকা প্রয়োজন? কত টাকা হলে সন্তুষ্ট হয় মন? একজন মানুষের চাহিদা কতটুকু? আমি জানি সবাই বলবেন এর কোনও স্থির একক উত্তর নেই। প্রতিটি মানুষের জন্য এর উত্তর ভিন্ন ভিন্ন। প্রত্যেকের চাহিদা, জীবনযাপন প্রণালি, চাওয়া-পাওয়ার ওপর  নির্ভর করে কত টাকা তার প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টি যখন ‘প্রয়োজনের’ সীমা ছাড়িয়ে ‘নেশায়’ রূপ নেয় তখনই সমস্যার শুরু। নেশার পরিমাপ কখনও স্থির থাকে না, নেশা কেবল বাড়তেই থাকে। সবচাইতে বড় কথা, নেশা মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে, নেশার বস্তু জোগাড় করতে হেন কাজ নেই যা মানুষ করতে পারে না।

আমাদের সমাজে এখন একটা বয়ান তৈরি হয়েছে। এই বয়ান আমরাই তৈরি করেছি, প্রোথিত হতে দিয়েছি সমাজের গভীরে। বয়ানটি হলো যে কোনও উপায়ে টাকা বানাতে হবে। টাকার উৎস কী, বৈধ নাকি অবৈধ, এর কোনোটি নিয়েই ন্যূনতম মাথাব্যথা নেই কারও। একটা সময় যখন টাকা সমাজের চোখে ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠেনি, তখনও কিছু রাখঢাক ছিল। পাড়ায় যে মানুষটি অবৈধ পথে টাকা বানাতো কিংবা ঘুষ খেতো, তাকে সবাই আলাদা করে চিনতো। মানুষ বাঁকা চোখে দেখতো আর ঘুষখোর মানুষটিও চলতো মাথা নিচু করে। অসৎ, দুর্নীতিবাজ মানুষের সন্তানরাও সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাদের সাথে নিজ সন্তানকে মিশতে দিতে আপত্তি ছিল অনেকেরই।

সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে পুরোটাই। এখন টাকা থাকাটাই মুখ্য পরিচয়, সেই টাকা কোথা থেকে কী করে এলো সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। টাকা বানানোটাই এখন যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি আর তাই যে যত বড় দুর্নীতিবাজ, সে মানুষের চোখে তত বেশি যোগ্য, সমাজে তার সম্মান তত বেশি। হাজার টাকার দুর্নীতি করে একসময় যেখানে মানুষ মাথা নিচু করে চলতো, সেখানে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি সমাজে আলাদা স্ট্যাটাস তৈরি করে, মানুষের মধ্যে ভয় মিশ্রিত সমীহ তৈরি করে। কিছু দিন আগে চলা শুদ্ধি অভিযান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কী বীভৎস পরিমাণ টাকা একশ্রেণির মানুষের হাতে মাত্র এক প্রজন্মে জমা হয়েছে। সেই টাকার না আছে কোনও বৈধ উৎস, না আছে জবাবদিহি। কিন্তু সেসব কিছুর চেয়েও ভয়ংকর হলো আমরা এতে কেবল যে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই না বরং এই দৌড়ে যে পিছিয়ে আছে তাকে অযোগ্যের তকমা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করছি না এক মুহূর্ত। এ সমাজে দরিদ্র হওয়াটা ভয়ংকর লজ্জার, চোর হওয়া নয়।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।