আলোকিত শাপলা চত্বর!

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ বুধবার দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নেপাল থেকে সাফ শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা নিয়ে ঘরে ফেরা নারীদের গোটা জাতি বরণ করে নিয়েছে গভীর ভালোবাসা আর তীব্র আবেগে। বাংলাদেশে ছাদখোলা বাসে বিজয়ীদের বরণ করে নেওয়ার ঐতিহ্য ছিল না। ইউরোপে বিভিন্ন দেশ বা দল বড় কোনও টুর্নামেন্ট জিতে দেশে বা শহরে ফিরলে ছাদখোলা বাসে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়। ট্রফি নিয়ে সেই বাসে তারা শহর প্রদক্ষিণ করেন। বাংলাদেশের বিজয়ী নারী দলের সদস্য সানজিদা টেলিভিশনে তেমন কোনও ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনার ছবি দেখে থাকবেন। হয়তো সেটি তার ভালো লেগেছিল। তাই ফাইনালের দিন জয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি লিখেছিলেন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।’

জয়ের পর সানজিদার এই না চাওয়াটাই গোটা জাতির দাবিতে পরিণত হয়। সরকারও সেই আবেগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে রাতের মধ্যে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসকে কেটে ছাদখোলা বাস বানিয়ে ফেলে। সেই বাসটিকে সাজানো হয় বিজয়ীদের ছবিতে। তারপরের ইতিহাস আপনাদের সবার দেখা। বিমানবন্দর থেকে বাফুফের পথে পথে লাখো মানুষ বরণ করে নিয়েছে বিজয়ী নারীদের। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। নিত্যকার যানজটকে বরণ করেছে আনন্দের সঙ্গে। ঢাকার রাজপথে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। যারা রাজপথে সরাসরি থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারেননি, তারাও টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন।

নারী ফুটবলারদের সাফ জয় হয়তো ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন নয়। এর আগে পুরুষ ফুটবল দলও সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছে। এর আগে ক্রিকেটও আমাদের অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রভাব বিবেচনায় নারীদের সাফ জয়টাই আমার কাছে সেরা। আসলে নারীদের যেকোনও অর্জনকেই আমি অনেক বড় করে দেখি। আমি জানি, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের কিছু অর্জন করতে হলে অনেক বেশি লড়াই করতে হয়। বাংলাদেশের একটি ছেলে লুঙ্গি কাছা মেরে ফুটবল খেলতে নেমে যেতে পারে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবল খেলতে নামলে ঘরে-বাইরে হাজারটা বাধা ডিঙাতে হয়। ফুটবল খেললে মেয়ের বিয়ে হবে না, এই ভয়ে পরিবারের অনেকে মেয়েদের ফুটবল খেলতে দিতে চান না। মেয়েদের ফুটবল বন্ধের দাবিতে এই বাংলাদেশে মিছিল হয়, মানববন্ধন হয়। এসব বাধা ডিঙিয়েই বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল খেলতে হয়, জিততে হয়। এ কারণেই মেয়েদের সাফ জয় আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পায়।

সাফজয়ী নারীদের বহনকারী ছাদখোলা বাসটি বিমানবন্দর থেকে বাফুফে কার্যালয়ে যেতে বনানী, মহাখালী, জাহাঙ্গীর গেট, বিজয় সরণি, সাতরাস্তা, আরামবাগ, মতিঝিল হয়ে যখন মতিঝিলে পৌঁছায়, তখন রাত হয়ে গেছে। তখনকার একটি ছবি আমার কাছে অন্য ব্যঞ্জনা, ভিন্নমাত্রা নিয়ে এসেছে। আলো ঝলমলে শাপলা চত্বরের ফ্রেমেই ঝলমলে উৎসবমুখর ছাদখোলা বাসটি। এই ছবিটি আমাকে একটু স্মৃতিকাতরও করে দেয়। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এর রাতটি যেমন আলো ঝলমলে, ২০১৩ সালের ৫ মে এই শাপলা চত্বরেই এসেছিল আরেক অন্ধকার রাত। সে রাতে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। এখন হেফাজতে ইসলাম সরকারের ‘পোষা’ হলেও সেদিন তারা অবস্থান নিয়েছিল সরকার পতনের লক্ষ্য নিয়ে। নামে ইসলামের হেফাজত করার কথা থাকলেও তারা আসলে ইসলামের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে ভাঙচুর, সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছিল।

সরকার পতনের আন্দোলন করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের আসল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশের প্রগতির বিরুদ্ধে, নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল তাদের। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার কথা নিশ্চয়ই আপনার ভুলে যাননি। ১৩ সংখ্যাটি এমনিতেই অশুভ। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির মতো এত অশুভ কোনও  ১৩ আমি আমার জীবনে দেখিনি। তাদের একটি দাবি ছিল ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।’ ১৩ দফায় আরও ছিল নারী নীতি-শিক্ষানীতি বাতিল করা, ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করা, ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার মতো দাবি। এই দাবিগুলো শুধু মধ্যযুগীয়, অসাংবিধানিক, মামাবাড়ির আবদারসুলভই নয়; এই দাবিগুলো অনৈসলামিকও। ইসলাম শান্তি আর উদারতার ধর্ম। ইসলাম কখনও অন্যের ধর্ম, অন্যের বিশ্বাসের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম সেই ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবিতেই শাপলা চত্বরের সমবেত হয়েছিল। হেফাজত হুমকি দিয়েছিল, ক্ষমতায় থাকতে হলে ১৩ দফা দাবি মেনেই থাকতে হবে। আবার ক্ষমতায় যেতে হলেও এসব দাবি মেনেই যেতে হবে। বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো, হেফাজতের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি।

হেফাজতের তখনকার আমির প্রয়াত আল্লামা শফির একটি ভিডিও পরে ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে তিনি নারীদের অবমাননা করে মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশে যখন নারী-পুরুষ কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে, দেশের অর্থনীতির প্রাণ গার্মেন্টস শিল্প যখন নারীর ক্ষমতায়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে; তখন আল্লামা শফী গার্মেন্টসে নারীদের কাজ করাকে তুলনা করেছিলেন ‘জেনা’ করার সাথে। তার পরামর্শ ছিল নারীদের ‘কেলাশ ফোর ফাইভ’ পর্যন্ত পড়ানোর, যাতে তারা স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। আল্লামা শফীর বিবেচনায় স্বামীর সেবা আর সন্তান লালন পালন করা ছাড়া নারীদের আর কোনো কাজ ছিল না। এইসব দাবি নিয়েই ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম।

কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো সেই অন্ধকার রাতেই হেফাজতকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। আল্লামা শফীর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের নারীরা আজ সকল বাধা টপকে এগিয়ে যাচ্ছে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে। বুধবার রাতে তাই আলো ঝলমলে শাপলা চত্বরে বিজয়ী নারীদের ছাদখোলা বাসটি দেখে তাই আমার মন ভালো হয়ে গেছে। নারীরা প্রগতির যে আলো জ্বালিয়েছে, তা নিশ্চয়ই আলোকিত করবে গোটা বাংলাদেশকেই। শুধু নিশ্চিত করতে হবে, সুযোগটা যেন নারীরা পায়। শুধু বাসের ছাদ নয়, নারীদের জন্য খুলে দিতে হবে সম্ভাবনার সকল দুয়ার।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ