উন্নয়ন লক্ষ্য হলে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখতে হবে

গত রবিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক (সৃজনশীল প্রশ্নের একটি অংশ) হিসেবে এমন বিষয় বেছে নেওয়া হয়, যা খুবই সংবেদনশীল। এতে সাম্প্রদায়িক উসকানি স্পষ্ট। অনেকেই বলছেন বাংলা প্রথমপত্রের ওই প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, যা পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও লেখালেখি হচ্ছে। এমন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও চার মডারেটরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা সবাই যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক।

যারা চিহ্নিত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে আইন ও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তারা যেন হিংসার শিকার না হন সেটাও দেখতে হবে। একই সঙ্গে সব শিক্ষকই এমন, এটা ভাবারও কোনও অবকাশ নেই। তবে এ কথা বলতে হবে যে এটি নতুন নয়। এর আগেও এমন কাণ্ড চোখে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী আদর্শে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার নজির আছে অনেক। বিজ্ঞানের যুক্তি দেখাতে গিয়ে পড়ুয়াদের আক্রমণের শিকার মুন্সীগঞ্জের হৃদয় মণ্ডলের কথা আমরা জানি। জানি সাম্প্রদায়িক হিংসায় আরও অনেক নিরীহ শিক্ষকের লাঞ্ছিত হওয়ার খবর।

এই মাটিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রগতিশীল বাম রাজনীতির শক্তি ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যতখানি সংগঠিতভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ বড় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ জাতি সেবন করছে, সেখান থেকে সরে আসতে পারছে না মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও। দিন যত যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের অরাজনৈতিক চর্চা, বামদের শক্তি ক্ষয় হওয়া ও অন্যদের মৌলবাদ তোষণের রাজনীতির সুযোগ নিচ্ছে বিভেদকামী মৌলবাদী রাজনীতি।

বাংলাদেশ গত ১৩ বছরে অর্থনৈতিকভাবে দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে, যদিও কোভিড-১৯ আর বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এবং নিজেদেরও নানা ব্যবস্থাপনা সংকটে বর্তমানে অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে আছে। ইট, কাঠ আর পাথরের অবকাঠামো উন্নয়নকে কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু জাতির মনোজগতে ভয়ংকরভাবে বাসা বেঁধেছে মৌলবাদ। এর কারণ অনেক। একটা বড় কারণ, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সংগঠন তাদের নিজস্ব রাজনীতি যতটা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে ক্ষমতার চর্চা। ফলে দলের ভেতর আধিপত্য কায়েম হয়েছে দুর্বৃত্তের, সমাজবিরোধীদের এবং অবধারিতভাবে মৌলবাদী সুযোগসন্ধানীদের।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে আর ক্ষমতায় যেতে মৌলবাদীদের ব্যবহার করার পরিণাম এই ধরনের প্রশ্নপত্র। অন্যদিক বাম রাজনীতির ভেতর থেকেও মেধাশক্তির কিংবা চিন্তাশক্তির ক্ষয় হয়েছে।

মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন অনেক দেশেই। রাজনীতি যখন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, আমাদের মতো ছোট দেশে বিশাল জনসংখ্যা যার মাথাব্যথার কারণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জঙ্গি খতম করা যায়, কিন্তু সেই রাজনীতিকে পরাজিত করতে যে রাজনীতি সেটা পুলিশ বা র‍্যাবের কাজ নয়। সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিষয়টির সঠিক চর্চা প্রয়োজন।

অনেক আগে থেকেই আমরা এই সত্যটা বলে আসছি। অনেকেই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বিপন্নবোধ করছেন। সম্প্রীতির শক্তিতেই বাংলাদেশের ঐক্যবন্ধন। সেই শক্তি একবার যদি আলগা হতে শুরু করে, তবে সমূহ বিপদ। একটা বড় বিপদ হলো কেউ কেউ মৌলবাদের জবাবে আরেকটি মৌলবাদকে আশ্রয় দিতে চান। এর কারণ তাদের মনোজগতেও সেই ধর্মই, মানুষ আর সমাজ নয়। এগুলোই সংকট বর্তমান অবস্থায়।

দেশের নেতারা দেখা যাচ্ছে অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছেন। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে রাজনীতি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউবে হিংসাত্মক ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচার। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এদের প্রচার। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এগুলো তাদের লাইক আর ভিউ পাওয়ার প্রচেষ্টা এবং পুঁজি হলো নারী বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদ।

প্রশ্ন হলো মানুষ কি এটাই চায়? চায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা কে গুরুত্ব দিচ্ছে? রাজনীতিতে এত বিভাজন যে এখানে ভোটদান পদ্ধতি নিয়েই বিতর্ক শেষ হয় না। গণতন্ত্রের প্রয়োগই এখন প্রশ্নের মুখে। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা ধরে রাখার যে রাজনীতি সেখানেই জন্ম নেয় অসহিষ্ণুতা আর সহিংসতা, যা আগ বাড়িয়ে ডেকে আনে সাম্প্রদায়িকতাকে। সাম্প্রদায়িকতার চরম শত্রু উদারতা ও যথার্থ গণতন্ত্র। তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, আমাদের এখন সেদিকেই বেশিমাত্রায় নজর দেওয়া দরকার। রাজনীতি হতে হবে সেই বিবেচনায়। উগ্রবাদী যে গোষ্ঠীতেই থাকুক, যে ধর্মেরই অনুসারী হোক, তাকে দমন করাই হবে এখনকার রাজনীতি। উন্নয়ন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে সরিয়ে রেখেই আমাদের এগোতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক