বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে?

গত একযুগের অধিক সময়ে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেটি বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হলে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনের কারণগুলো জানবার চেষ্টা করে থাকেন। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতেও বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

অতিসম্প্রতি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের কূটনীতিকগণ যৌথ বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ হয় সে ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

কূটনীতিকদের এ ধরনের বক্তব্য বিরোধী দল এবং সরকারি দল ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই ধরনের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করা হলেও, সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্যকে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।  এই ধরনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মধ্যে হঠাৎ করে গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাস থেকে তাদের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়। সেই বিবৃতির মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কোনও রাষ্ট্রের নেই। সেই বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে যারা নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।

এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য কোনও অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া বদ্ধপরিকর (প্রথম আলো, ২০/১২/২০২২)।

এ বছরের শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে ঘিরে মস্কো এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে নতুন করে যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার রেশ এবার এসে পড়েছে বাংলাদেশে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রুশ দূতাবাসের এই ধরনের বিবৃতি বিষয়টির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রুশ দূতাবাসের বিবৃতির একদিন পরেই ২১ ডিসেম্বর পাল্টা একটি টুইট করা হয়েছে মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে। একটি টুইট বার্তায় যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা হলো- "ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া এই নীতি প্রয়োগ করেছে কিনা?"(প্রথম আলো, ২১/১২/২০২২)।  অর্থাৎ দুই পরাশক্তির শীতল সম্পর্কের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পড়তে শুরু করেছে খুব শক্তভাবেই।

দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে খুব সন্তর্পণে সরাসরি কোনও পক্ষ অবলম্বন না করলেও সতর্কতার সাথে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।  স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা রয়েছে। ফলে, রাশিয়ান দূতাবাসের এই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছেন। আবার অনেকের মতে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, সেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে রুশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এই ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়ে থাকতে পারে।
তাছাড়া, রাশিয়া এবং ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের সাথে ভারতের সুসম্পর্কের জেরে রাশিয়া হয়তো এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। কারণ যেটাই হোক না কেন বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কূটনীতিকদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য যে বিষয়টি নির্দেশ করে তা হলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।  

তবে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন পরাশক্তির পরস্পরবিরোধী অবস্থান সেই দেশের রাজনীতির জন্য সুখকর কোনও ফল কখনোই বয়ে আনতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ গত একযুগের অধিক সময়ে যে উন্নয়ন অর্জন করেছে তার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য  নেতৃত্ব। আমরা সকলেই জানি যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল বক্তব্য হচ্ছে সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে।  

তবে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে যখন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয় সেটিকে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করবার অবকাশ নেই। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন পরাশক্তির সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। কারণ, যারা সরকারের পক্ষে বলবে তাদেরকে সরকারের বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আবার যারা সরকারের বিপক্ষে বলবে তাদের সাথে সরকারের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে মর্মে বিবেচনা করা হবে, যা কোনও স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল শক্তির উৎস হচ্ছে জনগণ। একটি দেশের সংবিধান হচ্ছে সেই দেশের মৌলিক আইন। সংবিধানের আলোকে সে দেশের জনগণ নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে এবং কাদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কোনও পক্ষাবলম্বন না করে জনগণের ওপর আস্থা রেখে সংবিধানের আলোকে দেশ পরিচালনা করাই হবে সরকারের জন্য যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত।  

ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কীভাবে সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রাষ্ট্রকে এবং জনগণকে রক্ষা করা যায়- সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। ফলে, উভয় রাষ্ট্রের যে বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত সেটি হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে এই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে সহায়তা করা।

নির্বাচন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী এবং সরকারি দল নির্বাচনকে ঘিরে বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। সংবিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকার যেমন বদ্ধপরিকর, ঠিক তেমনিভাবে সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজনের ব্যাপারে বিরোধীদল বদ্ধপরিকর। আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী দলের দাবি পূরণের জন্য যে সক্ষমতা প্রয়োজন সেই সক্ষমতা তাদের আছে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে না। তবে তারা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাদের সেই কৌশল কতটুকু সফল হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ফলে সরকার এবং বিরোধী দলের উচিত নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও ছাড় দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যেমন হুমকি, ঠিক তেমনিভাবে জনগণের জীবন এবং দেশের উন্নয়নের জন্য একটা বড় হুমকিস্বরূপ।

বিভিন্ন পরাশক্তি নিজেদের শীতল সম্পর্কের জেরে প্রদত্ত বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তার ওপর গুরুত্ব দেওয়াই বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। কারণ, আগামী নির্বাচনে জিততে হলে জনগণের ভোটে এই সরকারকে জিততে হবে। গত বছরের ১৪ বছরের উন্নয়নগুলোকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে এবং জনগণের জীবন ও জীবিকাকে সহজতর করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর শীতল সম্পর্কের মধ্যে নিজেদের না জড়িয়ে জনগণের ওপর আস্থা রেখে সামনের দিনগুলোতে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই হবে সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধরনের বক্তব্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে একটি বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়, বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।