শিক্ষক সমিতিগুলো ট্রেড ইউনিয়ন মেজাজে ফিরবে কবে?

২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। ‘শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন’ নামে পরিচিত শিক্ষক সমিতির নেতা নির্বাচনের জন্যই মূলত এই নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট, সিনেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচন একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর হলেও শিক্ষক সমিতি নির্বাচন প্রতিবছরই হয় এবং বছরান্তেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পরিচিত শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল নীল (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) এবং সাদা (বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত)  শিক্ষকরা এসময় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। টেলিফোনে, মেসেজে,  ইমেইলে,  লাউঞ্জে,  বিভাগে গিয়ে গিয়ে শিক্ষক ভোটারদের কাছে প্রার্থীরা দোয়া চাচ্ছেন, ভোট চাচ্ছেন।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে ‘নীল’ এবং ‘সাদা’ দলভুক্ত শিক্ষকই বেশি। তবে যে দল রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতায় থাকেন তাদের সদস্য সংখ্যা ‘স্বাভাবিকভাবেই’ বেড়ে যায়। এর বাইরে  বামদের জোটভুক্ত দল ছিল ‘গোলাপি’। আগে ‘গোলাপি’ সমর্থনকারী শিক্ষকরা আলাদা প্যানেল দিলেও মাঝেই মাঝেই তারা নীলের সঙ্গে বিলীন হয়েছেন।  বিগত বছরগুলোতে তারা নীলের সঙ্গে জোটভুক্ত হননি, তবে আলাদা প্যানেলেও দেননি।

এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে দেশের অন্যান্য নির্বাচনের মতোই এই নির্বাচনেও এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জৌলুস হারিয়েছে। ১০ বছর আগেও এই নির্বাচন নিয়ে টান টান উত্তেজনা ছিল। সেখানে দুইপক্ষের প্রার্থীরা জোরালো প্রচারণা চালিয়েছেন। এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলেও সাদা প্রার্থীরা কয়েকটি আসনে জয়লাভ করেছেন।

তবে এখন আর নির্বাচনি সংস্কৃতির সেই দিন নেই। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও সংস্কৃতি পাল্টেছে, তবে ভিন্নভাবে। এখন নীল দলের প্রার্থিতা নিয়েই তাদের নিজেদের মধ্যে ভয়াবহ টেনশন, উত্তেজনা, বিষোদগারের সংস্কৃতি জায়গা নিয়েছে। এখন আর বিরোধীদল লাগে না, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাই একে অন্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিদ্বেষ এবং চরিত্র হননমূলক লিফলেট প্রচার করছেন, নিজেরাই নানা বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। মিটিংগুলোতে শিক্ষকদের একে অন্যের বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক, অসৌজন্যমূলক এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে অতিমাত্রার আপত্তিকর কথাবার্তা শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচকতাই প্রকাশ করছে।

কেননা, এখন দল ক্ষমতায়। অনেকেই প্রার্থিতা চায়। আর এখন তো বেশিরভাগই নীল দলের সমর্থক। আগে যারা সাদা সমর্থক হিসেবে শুধু পরিচিতই নয়, সাদা দলের মিটিংয়ে সরব থাকতেন এবং সাদা দল থেকে প্রার্থীও হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখন নীলের তকমা লাগিয়ে নিজেকে আরও উজ্জ্বল করতে চাচ্ছেন। এই সাদাদের  অনেকেই  নানা কারণে কিংবা নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজতেই নীলের ছায়ায়। বিএনপির সময়ে যে নীল দলে টিকে ছিলেন মাত্র  ৩০-৪০ জন শিক্ষক। এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১৫০০, এখন আর মিটিং রুমে মাথা আটে না। শুধু তাই নয়, কে কার চেয়ে বেশি নীল সেটি প্রমাণের প্রতিযোগিতাও চলছে সমানে। এখানেও আছে ‘খাঁটি নীল’ এবং ‘বহিরাগত নীলের’ তকমা।

এখন সবাই নেতা হতে চায়। কারণ, সবাই জেনে গেছে এসব নির্বাচনে এখন যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে সেই জিতে যাবে। তাই এই সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায় না। শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয় প্রতিবছরই। নির্বাচিত নেতাদের উদ্দেশ্য আর ভোটারদের উদ্দেশ্য কি এক থাকে? এখন অনেকেই শিক্ষক সমিতির নেতা হতে চান, কারণ তারা জানেন এই সমিতির নেতা হওয়ার মধ্য দিয়ে অনেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই অনেকেরই উদ্দেশ্য থাকে সেটি।

তাই নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া বিবাদ-বিষোদগার সবই চালিয়ে নিয়েই মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা। এবার নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নীল দলের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এবার সভাপতি পদেই নীল দলের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দেনদরবার বহু করেছেন নীল দলের শিক্ষক নেতারা। কিন্তু ফলাফল আগের মতোই। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো নীল দলের সভাপতি হিসেবে দুই জন প্রার্থী।

এক্ষেত্রে খুশি হওয়ার কথা বিরোধী দল সাদার। নীল দলের দুই সভাপতি প্রার্থীর ভোট কেটে তাদের দিকে গেলে জয়লাভ করার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই অবস্থাকে মাথায় রেখে নীল দলের শিক্ষক নেতারা তাদের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখন সাদা দল শুধু তাদের অস্তিত্ব জানান দিতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। যদিও তাদেরও আছেন দুই, চার জন প্রার্থী, যারা সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি নির্বাচনে জিতেছেন।  তারাও যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে।

তবে কোথায় যেন কীসের অভাব! এখন হয়তো অনেকেই ফলাফলও অগ্রিম আন্দাজ করতে পারেন। হিসাবগুলো এখন আগের চেয়ে এত কঠিন নয়। অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। এখন আর কষ্ট করে ভোটে জিততে হয় না। এখন নির্বাচনগুলো হয়ে পড়ছে অনেকটা ‘নিয়ম’ রক্ষার নির্বাচন।

অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির তার মেজাজি চরিত্রের অনেকটাই খুইয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতি আর প্রশাসন এক হয়ে যাচ্ছেন। কারণ, প্রতিবারের মতো এবারও বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে আছেন এমন কয়েকজন শিক্ষক প্রার্থী হয়েছেন। প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকরাই যখন শিক্ষক সমিতির নেতা হন, তাহলে কে কার সঙ্গে দেনদরবার করবে? তাই তো অনেকটাই ‘আমরা-আমরাই’। তখন আসলে শিক্ষক সমিতি তার আলাদা মর্যাদা নিয়ে, শিনা টান টান করে দাঁড়াতে পারে না। সেটি প্রশাসনের অংশ হয়ে যায়। এবং আসলে সেটিই হচ্ছে। আপাতভাবে মনে হচ্ছে এই অবস্থার পরিবর্তন খুব বেশি হবে না। কারণ, এটিই এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ভোটাররাও অসহায়। তাদের স্বাধীন মনে হলেও মূলত স্বাধীন নয়। তাদেরও নানা হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। এসব সংকটের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আমরা। বিহ্বল নই, তবে নিশ্চিতভাবেই চিন্তিত শিক্ষকদের এই ট্রেড ইউনিয়নের দৈন্য নিয়ে।  

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

zobaidanasreen@gmail.com