‘ট্রল’ সংস্কৃতি ভয়ংকর হয়ে উঠছে

মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই লোকজনের শহর নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেই আগ্রহ একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মেট্রোরেলে কারা চড়বে, কারা চড়বে না সেটি নিয়েও আমাদের মনোজগতে রয়েছে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা। তা না হলে যখন আমরা জেনেছি, এই মেট্রোরেলেই এক নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলেছে নানান ‘হাস্যরস’। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী তিনি আগারগাঁও স্টেশনে এক ছেলে শিশুর জন্ম দেন। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্যই সন্তানসম্ভবা ওই নারী মেট্রোরেলে উঠেছিলেন। পরে ট্রেনেই সন্তান প্রসব করলে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসেছে। স্টেশনে পৌঁছার পর অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সবকিছুই স্বাভাবিক, স্বস্তির এবং মানবিক এবং এটাই হওয়ার কথা। কোথাও কোনও সমস্যা খুঁজে পাইনি।

কিন্তু এই খবরটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলেছে রীতিমতো ট্রল। অনেকে প্রশ্ন করেছেন কেন সেই অন্তঃসত্ত্বা নারী মেট্রোরেলে উঠলেন? অনেকেই বলছেন, তিনি আলোচনায় আসতেই এই কাজ করছেন। কেউ বলছেন– তার সন্তানের নাম ‘মেট্রো’ রাখা হোক। আরও কেউ কেউ এই বলে আলোচনার জোগান দিচ্ছেন যে সারা জীবন ট্রেনের ফ্রি টিকিট পাওয়ার জন্য ওই নারী নিজেই এই কাজ করেছেন। কেউ বলেছেন সাম্প্রতিক  সময়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় অনেক নারীই তাদের সন্তানের নাম পদ্মা রেখেছেন এবং সন্তানের নাম পদ্মা রাখাতে প্রধানমন্ত্রী অনেককেই উপহার পাঠিয়েছেন। সেই উপহারের লোভেই নাকি এই নারী মেট্রোরেলে সন্তান প্রসব করেছেন। আবার কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলেছেন, তিনিই প্রথম মেট্রোরেলে সন্তান প্রসব করা নারী হতে চেয়েছেন। তাই তিনি এই অবস্থায় মেট্রোরেলে উঠেছেন।

আরও নানা মন্তব্য করে ওই নারীকে ট্রল করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল এখন আর নতুন কিছু নয়। আমরা ট্রলপ্রিয় জাতিতে পরিণত হয়েছি। ট্রলের মধ্য দিয়ে ঠাট্টা-মস্করা, মজার নামে ঘৃণা, বিদ্বেষ যে পর্যায়ে ছড়ানো হয় তাতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে যাকে নিয়ে এই ট্রল করা হয় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কেননা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি হয়তো নেই কিন্তু তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা থাকেন, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এসবই আমরা জানি। এই লেখার মূল জায়গা কিন্তু তা নয়। কথা হলো আমরা ট্রল কেন করি? কেন আমাদের একজন গর্ভবতী নারীর মেট্রোরেলে ওঠা নিয়ে ট্রল করতে হবে? তার মানেই কি আমরা ধরেই নিচ্ছি গর্ভবতী নারীর ট্রেনে ওঠা নিষেধ? নাকি ট্রেনে প্রসব বেদনা ওঠা লজ্জার?

একটি প্রাকৃতিক বিষয় কীভাবে আমাদের মনোজগতে ট্রলের বিষয় হয়ে উঠতে পারে? কেমন করে এগুলো মজার বিষয় হয়ে ওঠে?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আগেও বিভিন্ন পাটাতনে ট্রল হতো। বিভিন্ন জনের ছবি নিয়ে কারসাজি করে সেটিতে এক ধরনের স্যাটায়ার থাকতো এবং একটি মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা চলতো। মূলত প্রতিবাদী পাটাতনগুলো এবং আন্দোলনে এই ধরনের স্যাটায়ারভিত্তিক ট্রলের চল ছিল। তবে এখন ট্রল মানেই হলো কাউকে অপদস্থ, হেয় করা এবং এটি কারও বিপক্ষে ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্য করা হয়। তবে এখানে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় এই ট্রলের শিকার হন নারী। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয়, জাতিগত এবং লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুরাও এই ধরনের ট্রলের শিকার হন এবং সেখানেই উদ্দেশ্য থাকে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো।

এই ঘটনাকেই যদি আমরা নিয়ে আসি সামনে তাহলে এই ট্রলের প্রভাবকে আমরা কীভাবে দেখবো? কোনও গর্ভবতী নারী আর যানবাহন ব্যবহার করতে চাইবেন না। কারণ, তিনি জেনে গেছেন রাস্তায় তার সন্তান জন্মদানের অবস্থা হলে তিনি হেনস্তার শিকার হবেন, তাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হবে। এমনই নারীরা গর্ভাবস্থাকে ‘লজ্জার’র বিষয় মনে করেন এবং এ সময় চাকরিজীবী ছাড়া খুব কম নারীই পাবলিক পরিসরে আসতে চান না। তাই মেট্রোরেলে বাচ্চা প্রসবকে কেন্দ্র করে এই ধরনের ট্রল নারীকে আরও বেশি সংকুচিত করবে।

গর্ভবতী নারীকে নিয়ে এই ধরনের ট্রল আরেকভাবে ভয়াবহ নারী বিদ্বেষকেও ইঙ্গিত করে। আমরা বিভিন্নভাবেই নারীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াই। এবং গর্ভবতী নারীর প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। তাই ট্রলকে শুধু নিরীহভাবে ‘হাসির’ কিংবা ‘মজার’ বিষয় না থেকে এই ট্রলিংয়ের পেছনের রাজনীতিকে দেখতে হবে।

আমরা প্রতিদিনই কোনও না কোনও ভয়ের মধ্যেই জীবন টেনে নিচ্ছি। ট্রল সেই ভয়ের রাজ্যেরই আরেকটি নতুন সংযোজন। আমরা না জেনেই না বুঝেই অনেক বিষয় নিয়ে ট্রল করছি এবং এর উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে অন্যে হেয় করা। ট্রল সৃষ্টির ইতিহাস এবং এর রাজনৈতিক ব্যবহারকে পাশ কাটিয়ে এখন অনেক ইতিবাচক বিষয়কেও মানুষ ট্রলের শিকার হওয়ার ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপন করতে ভয় পায়। এবং এভাবে ট্রল আমাদের জিইয়ে থাকা ভয়ের সংস্কৃতিতে নতুন ধরনের ভয়ের উপকরণ তৈরি করছে।

তাই ট্রল করার আগে নিজের কাছে পরিষ্কার থাকুন, ট্রল কী নিয়ে করছেন এবং কেন করছেন? এই ট্রল করার কারণে অন্যদের কী কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে এবং এটির প্রভাব কী কী হতে পারে? কিন্তু আমরা এগুলো ভাবি না। কেউ একজন ট্রল করা শুরু করলে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বিপরীতে না দাঁড়িয়ে সেই ট্রলিংয়ে অংশগ্রহণ করি এবং এটিকে ‘মজার’ বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করি। এই প্রবণতাই এখন আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি বড় সংস্কৃতি হয়ে পড়েছে। এই সংস্কৃতির ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না তা-ও নয়, তবে এটিকে থামানো যাচ্ছে না। অনেকেই আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের সচেতনতাই হবে এটি রোখার সবচেয়ে বড় জায়গা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com