দুর্নীতির গণতন্ত্রীকরণ

যা কিছু অবধারিত তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম। বাংলাদেশের দুর্নীতিও ঠিক এমনই। এটি কেবলই বাড়ে, এ দেশের মানুষ কবে দুর্নীতি কমতে দেখেছে সেটা জানা নেই। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেলো, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এর আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম।

গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের একধাপ অবনমন হয়েছে। টিআই বলেছে, ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫, যা গতবারের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। একদিন আগে, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২২: উদ্যোক্তা জরিপেও বলা হলো– দেশে ব্যবসায় বড় বাধা দুর্নীতি।

এই যে ঘটা করে একটা তথ্য প্রকাশ করা হলো, এতে মানুষের সত্যিকারের আগ্রহ কতখানি? আমার মনে হয় খুব বেশি নেই। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ মনেই করে যে এখানে দুর্নীতি হয় মুড়িমুড়কির মতো। বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বিপুল, তার গভীরতা অতল। দুর্নীতির অভিযোগ এমনই অভাবনীয় যে কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ, বুঝে ওঠা যায় না।

কেন দুর্নীতি বাড়ছে? এমন প্রশ্ন করা হলে, অনেক উত্তর আসবে। কিন্তু, আমার ধারণা আসল সত্য হলো, আমাদের শাসন ব্যবস্থা দুর্নীতির এক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আম জনতা বিশ্বাসই করে না যে দুর্নীতিগ্রস্তের শাস্তি হতে পারে।

তো, এমন এক শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি বাড়ছে সেটা সত্যি কোনও বড় খবর নয় আসলে। দেশের সাধারণ মানুষ, ছোট-বড় সব শহরের মানুষ, সমাজে বিরাজমান সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে বিষণ্ণ রয়েছেন। এবং এর কারণ হলো, মানুষ দেখছে যে দুর্নীতির নিরিখে বাংলাদেশের বহু বছর ধরেই বেশ উপরের দিকে থাকছে। তারা ভালো করেই বুঝতে পারছে যে গণমাধ্যমের রিপোর্ট, দুদকের তদন্ত, সরকারের নানা প্রচেষ্টা এবং দুর্নীতি রোধের আইনি ব্যবস্থা দুর্নীতি কমাতে পারছে না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং ব্যবসায়িক পরিসরে যারা ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রে অবস্থান করে, তারা এমন একটি শাসন ব্যবস্থা চালু রেখেছে যে সেখানে দুর্নীতি প্রতিরোধের কোনও সুযোগই নেই। সাধারণ মানুষকে ছোট ছোট দুর্নীতিতে অভ্যস্ত করে বড় দুর্নীতির এক গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টিতে আমাদের শাসনব্যবস্থা অনন্য। সরকারি দফতরে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ আসে সেগুলোর বড় একটা অংশই বিচারযোগ্য নয়। কারণ, এগুলো আদালত অবধি গড়ায় না। বিভাগীয় তদন্ত ভালো হলে সেসব দুর্নীতি কমানো সম্ভব, কিন্তু সেটা হবার নয়। এর অর্থ হলো, দুর্নীতির বিচারযোগ্য অভিযোগের খুব কমই নথিভুক্ত হয়, তারচেয়েও কম হয় চার্জশিট দাখিল এবং নিশ্চিতভাবে শাস্তি হয় নিতান্তই কম। কতদিন বিচার চলে বা শাস্তির বহর কতটা, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যই শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

শাস্তির ভয় যদি প্রকৃত এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অতি কার্যকর প্রতিরোধক হতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতে বিশ্বাসী নয়। তারা দুর্নীতির যেকোনও অভিযোগ অস্বীকারের মাঝে রোমাঞ্চ খোঁজেন।

শাস্তির ভয় যদি প্রকৃত এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অতি কার্যকর প্রতিরোধক হতে পারে। আমাদের এখানে হয় ঠিক বিপরীতটা। এখানে সাধারণ ধারণাই হলো যে দুর্নীতি করলে সমস্যা নেই। ধরা পড়ার ঝুঁকিও কম। এবং ধরা পড়লেও তারা জানে সম্ভাব্য শাস্তির খরচ দুর্নীতি থেকে যে আয় হয়, সেটার চেয়ে অনেক কম।

দুর্নীতি খারাপ, অনৈতিক, সেই কারণেই তা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য – এমন ধারণা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেই। এ দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায়ও এমন কিছু আছে, যাতে মনে হতে পারে দুর্নীতি সর্বজনগ্রাহ্য। এই সার্বিক দুর্নীতিগ্রস্ত অভিযোগ আজ এমনই প্রকট। তার অন্যতম কারণ হলো, দেশের রাজনৈতিক শ্রেণি তাদের ক্ষমতাকে দুর্নীতির পক্ষে ব্যবহার করছে অনাদিকাল ধরে।

যে দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রকেই কার্যত খুলে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনি মুনাফা অর্জনের জন্য, সে দেশে দুর্নীতিই স্বাভাবিক। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মীই বুঝে নিয়েছেন যে অন্যায় পথে রোজগার করাই দস্তুর। শাসক দলের ভেতর এই প্রবণতা আরও প্রবল।

একটা কথা যদি বলা হয় যে দেশে রাজনীতিই কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্র, তবে কি ভুল বলা হবে? সামাজিক স্তরে এই অবিশ্বাসের চাষ চলছে বহুকাল ধরে। মানুষ ধরেই নিয়েছে যে রাজনীতিই দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র। বলা চলে, এই সংস্কৃতি সব দলে বিরাজমান। রাজনৈতিক বিরোধ যতই থাকুক, দুর্নীতির প্রশ্নে তাদের ঐক্য প্রশ্নাতীত। দুর্নীতির এমন গণতন্ত্রীকরণের দৃষ্টান্ত আজকের পৃথিবীতে বিরল।  

আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও নাগরিক সমাজ– প্রত্যেকেই দুর্নীতির অধিকারী। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যেনতেনভাবে অতিমাত্রায় রোজগার না করতে পারলে কোনও জায়গা নেই সমাজে। মানুষ আজ প্রশ্ন করছে– উন্নয়ন আর দুর্নীতি কি হাতে হাত ধরেই চলবে? এই প্রশ্নের সমাধান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে না এলে দুর্নীতির প্রতিরোধ সম্ভব নয়।

লেখক: সাংবাদিক