স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য দরকার স্মার্ট রাজস্বনীতি

বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের যুগে আমরা বাস করছি। চোখের নিমিষেই সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তন হতে বাধ্য। আপনি আমি চাই বা না চাই, এই পরিবর্তন দরজায় কড়া নাড়বেই। কেউ ইচ্ছা করেও এই পরিবর্তনকে ঠেকাতে পারবেন না।

প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে অনেকটা চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে বা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অকেজো হয়ে পড়তে পারে। আমাদের সমাজে প্রযুক্তির কল্যাণ এখন ঘরে ঘরে। এই কল্যাণকে যদিও মাঝে মাঝে অকল্যাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটা ভিন্ন ইস্যু। আজকের বিষয় হলো স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট রাজস্বনীতি। এই দুই স্মার্ট নিয়ে আলোচনার আগে নজর দেওয়া যাক স্মার্ট দেশ আসলে কী? কী করলে আমরা স্মার্ট হবো। এই বিষয়ে ভাবা দরকার। আজকের লেখক হিসেবে জ্ঞান এতটাই কম যে উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তেমন কিছু বোঝানো যাবে না। তবে প্রচলিত রীতিনীতি, বিবর্তনের পরিণতি দেখে দেখে যা জানতে পারা, তা বলাই এই কলামের উদ্দেশ্য।

কথায় কথায় বা মাঝে মধ্যে কোনও একটা ছেলেকে বা মেয়েকে দেখে আমরা বলি ‘স্মার্ট ছেলে’ বা ‘স্মার্ট মেয়ে’ বা কত ‘স্মার্ট লোকটা’ ইত্যাদি। এই স্মার্টনেসটা প্রকাশ পায় একটা মানুষের চলাচল, পোশাক পরিচ্ছদ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কথা বলার ভঙ্গি, অন্যকে সম্মান দেখানোর ভঙ্গি, আইন-কানুন মেনে চলার অভ্যাস, কথা দিয়ে কথা রাখার অভ্যাস, অন্যের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া, অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা, বিনয়ী স্বভাব, গোছালো বাচনভঙ্গি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই চরিত্রগুলো একজন মানুষকে স্মার্ট হতে বাহ্যিক রূপদান করে।

গভীর চিন্তা করলে দেখবেন সব চরিত্রের অন্তরালে আর্থিক সক্ষমতার একটা বিষয় লুকিয়ে আছে!

আমরা একসময় স্কুলে পড়েছি জাপানি শিশুদের গল্প। সেখানে বলা ছিল জাপানি শিশুরা কান্না করতে জানে না। কেন তারা কান্না করতে জানে না? এটা স্বাভাবিক কান্না নয়, এই কান্নার গভীরতা অনেক। কারণ, সে তার জন্ম থেকে কাউকে অধিকারের জন্য কান্না করতে দেখেনি, পরিবারের কেউ অন্যকে বিনা কারণে কষ্ট দেয়নি, অন্যকে ঠকিয়ে নিজেরা বড় হওয়ার কাজটি কেউ করেনি, ভাইবোনের অধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনও নোংরামি হয়নি, সমাজে একে অন্যকে কেউ খাটো করেনি; একইভাবে রাষ্ট্র কারও অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি, সমাজপতি, রাজনীতিবিদ একে অন্যের সম্মানহানি করেনি; এমনকি তাদের স্কুল, কলেজগুলোতেও কখনও কোনও কামড়াকামড়ি বা হানাহানি হয়নি। এসব কারণে জাপানি শিশুরা কান্না করতে শিখে না। এটাই রাষ্ট্রের প্রথম স্মার্টনেস। সার্বিক পরিবেশ তাদের স্মার্ট জাতি হিসেবে বিশ্বে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এই জন্য তাদের স্মার্ট হওয়ার জন্য কোনও নেতাকে ঘোষণা দিতে হয় না। কারণ, সকল নাগরিকই তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন। এখানেও দেখুন আর্থিক স্বচ্ছতার একটা বিষয় লুকিয়ে আছে।

আমরা যদি একটা স্মার্ট ভিলেজ বা গ্রামের কথা চিন্তা করি, তাহলে কী কী উপাদান থাকবে দেখি–

১/ চলাচলের জন্য উন্নত রাস্তা থাকা; ২/ প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি ও অন্যান্য পেশায় প্রযুক্তির ব্যবহার থাকা; ৩/ দক্ষ শ্রমিক, পেশাজীবী থাকা; ৪/ প্রযুক্তির ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত হওয়া, ৫/ শিশুদের শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা; ৬/ স্বাস্থ্যসেবার জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল/ক্লিনিক, ডাক্তার থাকা; ৭/ শিশুদের খেলার মাঠ থাকা; ৮/ বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকা; ৯/ নবীন-প্রবীণদের জন্য পাঠাগার থাকা; ১০/ প্রবীণদের পরিচর্যা কেন্দ্র থাকা; ১১/ আইনি সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ১২/ ধর্মীয় আচারণ পালন করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা ইত্যাদিসহ সরকারি সব পরিষেবা নিশ্চিতভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা। এই উপাদানগুলো বিদ্যমান থাকলে একটা গ্রামকে আমরা স্মার্ট গ্রাম বলতে পারি। একইভাবে একটা রাষ্ট্রকে যদি স্মার্ট করতে হয় তাহলে এই উপাদানগুলো গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল স্মার্ট রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব।

এখানেও চিন্তা করে দেখুন, আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি জড়িয়ে আছে গভীরভাবে।

এই উপাদানগুলো নিশ্চিত করতে হলে দরকার অর্থের সংস্থান, তথা ব্যাপক হারে রাজস্ব আহরণ। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন দেশের কর জিডিপি বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রতি যে শর্ত দিচ্ছে তার বাস্তবায়ন করতে হলেও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। এই রাজস্ব আহরণ কীভাবে প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে আরও গতিশীল ও স্মার্ট করা যায় তা নিয়ে দেশে দেশে চলছে নানান গবেষণা। প্রযুক্তির ব্যবহারের কল্যাণে অনেকটা সহজ হলেও চ্যালেঞ্জগুলো সামনে রেখেই চলছে পরিবর্তন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্মার্ট রাজস্বনীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করার জন্য আমার এই সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে: যেমন–

১. নাগরিকদের মধ্যে কর সচেতনতা বৃদ্ধি করা;

২. কর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও করদাতার মধ্যে সুসম্পর্ক উন্নয়ন;

৩. করদাতা নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় পরিষেবায় অগ্রাধিকার দেওয়া;

৪. প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা;

৫. ট্যাক্স কাউন্সিল গঠন করে অভিজ্ঞ কর পেশাজীবী তৈরি করা;

৬. তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সঙ্গে কর ইউনিট খোলা এবং একজন আয়কর পেশাজীবীকে দায়িত্ব প্রদান করা। এতে করদাতা তার কাছ থেকে সহযোগিতা পাবে এবং কর দিতে উৎসাহিত হবে;

৭. একজন নাগরিকের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির/সম্পদের ন্যূনতম সিলিং ঠিক করা; যে সিলিং অতিক্রম করলেই যেকোনও নাগরিককে আয়কর ও আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক হবে;

৮. করভীতি দূর করার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো;

৯. করদাতাদের সহযোগিতার জন্য আয়কর রিটার্নের সঙ্গে আয়কর পেশাজীবীদের ওকালতনামা বাধ্যতামূলক করা;

১০. নাগরিকদের মধ্যে করন্যায্যতা নিশ্চিত করা;

১১. সরকারি কর্মকর্তা; বেসরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ না করে সবার জন্য সমান নীতিগ্রহণ করা;

১২. নিয়মিত করদাতাদের জন্য অন্যান্য পরিষেবার কর প্রত্যাহার করা;

১৩. ইচ্ছাকৃত কোনও নাগরিক আয় গোপন করলে বা কর ফাঁকি দিলে কোনও ছাড় না দিয়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা;

১৪. সার্কেলভিত্তিক বাধ্যবাধকতা দূর করে করদাতার নিকটবর্তী যেকোনও সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার সুযোগ দেওয়া;

১৫. করদাতাভিত্তিক ই-তথ্য ভাণ্ডার চালু করা। যাতে শুধু ইটিআইএন দিয়েই করদাতা আয়কর নথি তালাশ ও প্রয়োজনীয় তথ্য চেক করতে পারেন এবং ট্যাক্স সার্টিফিকেট, প্রাপ্তি স্বীকার ও রিটার্ন সংগ্রহ করতে পারেন। এসব সুপারিশকে নতুন আইনে সন্নিবেশ করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় গ্রহণ করেছেন তার বাস্তবরূপে দেখতে হলে করদাতাদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি করদাতাবান্ধব রাজস্বনীতি গ্রহণ করাও জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি স্মার্ট রাজস্বনীতিই পারবে একটি স্মার্ট আর্থিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে। আর একটি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার, তা নিশ্চিত করবে একটি স্মার্ট রাজস্বনীতি; এর কোনও বিকল্প নেই।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

sskbdtaxvat@gmail.com