আবার সংলাপ!

নির্বাচন কমিশন আবার সংলাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আগেও সংলাপে বসেছিলেন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। সংলাপ হয়েছিল নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সাথেও।

গত জুলাইয়ের সেই সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছ থেকে ৩২০টি প্রস্তাবও আসে। এসব প্রস্তাব পর্যালোচনার পর একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে কমিশন।

প্রশ্ন হলো, রোডম্যাপ জানিয়ে দেওয়ার পর আবার কেন সংলাপ? সেই জুলাই মাসের সংলাপে যায়নি অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। যায়নি সিপিবি, বাসদসহ আরও অনেকে এবং বিএনপির মিত্ররা। আগের সংলাপ বর্জনকারী বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোকে এবার আবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইসি। কিন্তু বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, বর্তমান সরকারের অধীনে দলটি নির্বাচনে যাবে না। কাজেই ইসির সংলাপের আহ্বানে তারা সাড়া দেবে না। অন্যদিকে ইসিও বলে আসছে, এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই।

দুই পক্ষের যখন এমন অনড় অবস্থান তখন কেন আবার সংলাপ? একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, হাবিবুল আউয়ালের কমিশন বলতে চায় যে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে, নিজেদের ঘাড়ে কোনও দোষ না রাখতে।

বিএনপি একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। নেতারা পরিষ্কার করেই বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগ রাজি না হলে সংলাপের মাধ্যমে সংকট কাটানোর সম্ভাবনা নেই। আওয়ামী লীগ তার অবস্থানে দৃঢ় যে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথায় ফিরে যাওয়া হবে না।

এই যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন নির্বাচন কমিশন আবার চেষ্টা করছে সংলাপের, যা তার বরাবরের অবস্থানকে সামনে নিয়ে এসেছে। কারণ, কমিশন সেই শুরু থেকে বলছে সব দলকে নির্বাচনে আনা তাদের দায়িত্ব নয়। কাজেই আগ্রহী দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করবে। অন্যদিকে তারা আবার সংলাপের আমন্ত্রণও জানাচ্ছে। এই অবস্থান অবশ্যই সাংঘর্ষিক।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ উঠে এসেছে এসব সংলাপে তার সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। সমাধান করতে হবে দুই বড় দলকেই, সেখানে নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে বলে কোনও কিছু দৃশ্যমান নয়। যারা রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের অনেকে মনে করছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকরা যে চাপ দিচ্ছেন তাতেই সাড়া দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আবার অনেকে বলছেন, এটা সরকারেরই একটা কৌশল। সরকার দেখাতে চায় যে নির্বাচন নিয়ে কমিশন স্বাধীনভাবে সব প্রচেষ্টা নিচ্ছে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে এটি নির্বাচন কমিশনের একটি সৎ প্রচেষ্টা, এমনটা কেন আমরা ভাবতে পারছি না, কেন সন্দেহ করছি, সেখানেই নিহিত রয়েছে আসল সত্য। বাংলাদেশের রাজনীতি এতটাই বিভাজিত ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে, কোনও বিশ্বাস বা আস্থার জায়গা কোথাও নেই আর এখন।

রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস করেন না বলেই অরাজনীতিকদের দিয়ে নির্বাচন করাতে চান।

একটা সুষ্ঠু, স্বাভাবিক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সে জায়গা থেকে নির্বাচন কমিশন সব দলকেই চিঠি দিতে পারে কথা বলার জন্য। কারণ, কমিশনের দায়িত্ব সব দলকে নির্বাচনে আনা এবং কথা বলা। কিন্তু নির্বাচনি মাঠে বড় খেলোয়াড় রাজনৈতিক দল। তারা যদি শান্তিপূর্ণ ও ভোটার আস্থার পরিবেশ বজায় রাখেন, তাহলে শুধু কমিশনকে দিয়ে নির্বাচন ভালো হবে না। কমিশনকেও কথাটা পরিষ্কার করে বলতে হবে যে সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে চায়, তবে সে ক্ষেত্রে পরিবেশ তৈরি করতে হবে সরকার ও সরকারি দলকে।

বিএনপির দিক থেকেও আমরা আশা করতে পারি যে দলটি কথা বলার জায়গাটা বন্ধ করে দেবে না। শাসক দল, নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে দলের যে বক্তব্য আছে সেটাই তারা বলে আসুক সংলাপে গিয়ে। কোনোভাবেই যেন কথোপকথন বন্ধ না হয়ে যায়, সেটাই প্রত্যাশিত। আলোচনায় না যাওয়া মানে বিএনপি একটা প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করলো না। বিএনপি নেতারা তারা কমিশনের সঙ্গে বসে তাদের দাবিগুলো তুলতে পারেন। যদি নাই গেলো তাহলে তো দাবির কথা অনুচ্চারিত থেকে গেলো।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচন চায় না, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, বরং সারা দেশে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে জোটবদ্ধ নির্বাচন করেও ভরাডুবির ফলাফল দেখতে হয়েছে। অবশ্য দুটি নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা গেছে বলে বিএনপি মনে করে এবং সেটাকেই সে রাজনৈতিক সাফল্য বলে মনে করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচন যতই প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের বলা হোক না কেন, বাস্তব সত্য হলো, নির্বাচন হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ প্রতিবারই পূর্ণ মেয়াদে দেশ শাসন করেছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, এই সরকার অবৈধ। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে সরকারকে এটা বলা যাচ্ছে না। এবং সেই সরকারের কাছেই তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার করার দাবি পেশ করতে হচ্ছে বিএনপিকে। তারা বলেন, সরকার জনসমর্থিত নয়। কিন্তু তাতে কি সরকারের দেশ পরিচালনায় কোনও সমস্যা হয়েছে? জনসমর্থন নিয়ে সরকারকে হটানোও যায়নি। তাই সংলাপ ও আন্দোলন দুই ক্ষেত্রেই বাস্তবতার নিরিখে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতিতে সবসময়ই শুনে আসছি শেষ কথা বলে কিছু নেই।

লেখক: সাংবাদিক