নিরীহ করদাতা, নাগরিক পরিষেবা ও প্রস্তাবিত বাজেট!

বিগত অর্থ বছরের পুরো সময় জুড়ে ছিল অর্থনীতির খারাপ অবস্থার পূর্বাভাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজ্ঞজনেরা বিভিন্নভাবে সতর্ক করে আসছিলেন। প্রতিটি নিত্যপণ্যের বাজারদর প্রতিনিয়ত বাড়ছে লাগামহীনভাবে।  

অনেকেই বলছেন– আইএমএফে’র ঋণের শর্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে আটা, চাল, তেল, শিশুখাদ্য, শিক্ষা-উপকরণসহ সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। যার কারণে এমনিতেই সাধারণ আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ এর প্রস্তাবিত বাজেটে আটা, কলম, থালাবাসন, খেজুর, চশমা, টিস্যু, গ্যাস সিলিন্ডার, বাইসাইকেল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। আটা দিয়ে বিভিন্ন শিশু খাদ্য তৈরি, হাসপাতালে শয্যাশায়ী রোগীদের পথ্য হিসেবে রুটি তৈরি হয় এই আটা থেকে। কলম হলো শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। শিক্ষা উপকরণের দাম এমনিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে, এখন আরও বাড়বে। যার ফলে গরিব অভিভাবকের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। চোখের সমস্যা থাকলে চশমা পরতে হয়। সাধারণ নাগরিকদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে চশমা ব্যবহার করতে হবে; গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া খাবার তৈরিতে নিম্ন আয়ের মানুষের খরচ বৃদ্ধি পাবে। বাইসাইকেল ব্যবহার করে সাধারণ পরিবারের লোকেরা। বিশেষ করে গরিব ঘরের শিক্ষার্থীরা বাইসাইকেল ব্যবহার করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে। এই সাইকেল ব্যবহারেও অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে। মোট কথা হলো নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে বৈষম্য ব্যাপক হারে বাড়বে। একদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সীমিত, অন্যদিকে প্রায় পরিবারে এক/দুইজন বেকারের বোঝা বহন করা সাধারণ পরিবারের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ ট্যাক্স দাতারা হতাশ। যাদেরকে ‘নিরীহ করদাতা’ বলা যায়। খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনে টিআইএন নিয়েছেন অনেক নাগরিক। আয়-রোজগার নেই এমন টিআইএনধারী নাগরিকরা শূন্য রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। ন্যূনতম ২ হাজার টাকা ট্যাক্স বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। ফলে যে সকল নাগরিকদের বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার আয় নেই, তাদেরকেও ২ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। অন্যদিকে ৪৪টি পরিষেবার ওপর ট্যাক্স রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখাতে হবে। তার মানে হলো টিআইএনধারী সকল নাগরিককে ট্যাক্স বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। অন্য দিকে ধনী করদাতার জন্য সারচার্জ ছাড় দেওয়া হয়েছে। সারচার্জ ৩ কোটি টাকার পরিবর্তে  ৪ কোটি টাকার নিট সম্পদের সীমা নির্ধারণ করায় ধনী ব্যক্তিরাই ট্যাক্স ছাড়ের আওতায় পড়বেন। যার ফলে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ আয়সীমা ন্যূনতম ট্যাক্স নির্ধারণে তেমন কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

রাজস্ব আদায় টার্গেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিগত অর্থ বছরের ঘাটতি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা (সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১ মে ২০২৩)। এই ব্যাপক রাজস্ব আদায় করার ক্ষেত্র সীমিত থাকায় বাজেট বাস্তবায়ন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। অনেকটা অসাধ্যকে সাধন করার মতো হবে। যারা ট্যাক্স দেবেন তাদের আয়ের খাত সৃষ্টি না করে, ট্যাক্স আদায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

একইভাবে আইএমএফের শর্তপূরণ করা এবং ঋণের পরবর্তী কিস্তি গ্রহণ ও বর্তমান ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সরকারের জন্য রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনও বিকল্প পথও নেই।

এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি রাজস্ব খাত, নাগরিক ও রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতি থেকে অবশ্যই বের হতে হলে সকল স্তর থেকে কৌশলী হতে হবে। কৌশলী না হলে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির প্রভাব প্রতিরোধ, অর্থনৈতিক স্বাভাবিক নীতির প্রয়োগ ও নাগরিকদের মৌলিক পরিষেবা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নিম্নে সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

১. পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, বা তা বাজেয়াপ্ত করা;

২. অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

৩. বছর শেষে নিট সম্পদ ৩ কোটি  টাকা আছে এমন নাগরিকদের নিট সম্পদের ওপর সারচার্জ বৃদ্ধি করা;

৪. অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুলোর ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বাধ্যতামূলক না করা;

৫. ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা দিতে হলে করদাতাকে স্বাস্থ্য কার্ড ইস্যু করে, বিনা ফি’তে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করা;

৬. ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য সরকারি/ বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা;

৭. ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধিও জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দেওয়া;

৮. বেকার তরুণদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করে দক্ষ নাগরিক তৈরি করে, উন্নত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের জন্য লবিং জোরদার করা;

৯. ব্যাপক হারে কৃষি কাজে উৎসাহিত করা;

১০. করফাঁকি রোধে নজরদারি বৃদ্ধি করা;

১১. সঠিক করদাতা চিহ্নিত করার জন্য কর আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করা;

১২. নাগরিকদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে কোনও প্রকার শর্তের ঋণগ্রহণ না করা;

১৩. যুব সমাজকে ব্যাপকহারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা;

১৪. করের টাকা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার বন্ধ করা;

১৫. সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি-বাড়ি দেওয়া ও তা পরিচর্যা ব্যয় হ্রাস করা;

১৬. অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা;

১৭. সরকারি ক্রয়নীতি কঠোরভাবে মনিটরিং করে ব্যয় হ্রাস করা; 

১৮. এখনই প্রয়োজন নেই এমন বড় প্রকল্প গ্রহণ না করা;

১৯. উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার ওপর জোর দেওয়া;

২০. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা; ইত্যাদি। 

এছাড়া দরকার দেশের জন্য একটি জাতীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা। কারণ আমাদের আমলা নির্ভরতা ও তোষামদিও পরিবেশ এমন জায়গা গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সকল কাজেই তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিচ্ছে। আমলা নির্ভর হয়ে বাজেট করা যায়, কিন্তু কঠিন পরিস্থিতি সামলানো যায় না। তাই এই বাজেট বাস্তবায়ন, কার্যকর করার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা ও তা কার্যকরভাবে মনিটরিং করার মাধ্যমে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন করার মাধ্যমে নিরীহ নাগরিক তথা করদাতাকে যেমন সন্তুষ্ট করা যাবে, তেমনি এই কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা কিছুটা সহজ হতে পারে।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

sskbdtaxvat@gmail.com