নওয়াজের আক্ষেপ এবং ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান

পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশে ফিরতে মরিয়া। ফের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার বাসনাও গোপন নেই।

তবে এমন সন্ধিক্ষণে নওয়াজ তার পূর্বসূরিদের পথে চলেননি। হিন্দুস্তানকে গালমন্দ না করে জলস্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা পাক নেতাদের মতো তিনি ‘চির শত্রু’ ভারতের বিরুদ্ধে তোপ দাগেননি। বলেননি, আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে হিন্দুস্তানের কবল থেকে কাশ্মির ছিনিয়ে নেবেন। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী উল্টো হিন্দুস্তানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতের চন্দ্রায়ন মিশনের সাফল্য তুলে ধরে ক’দিন আগে বিদেশি মিডিয়ার সামনে প্রশ্ন তুলেছেন, হিন্দুস্তান আজ কোথায়, আর কোথায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তান! হিন্দুস্তান চাঁদে মহাকাশ যান পাঠাচ্ছে, আর পাকিস্তান দেশে দেশে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হচ্ছে।

নওয়াজ শরিফের গলায় এমন বেসুরো কথাবার্তার আসল উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। তিনিও জানেন, পাকিস্তানের মানুষকে আর হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা সহজ হবে না। পেটে ভাত না থাকলে দেশপ্রেমের টেপ সেঁটে ক্ষুধার্থ মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না। এমনিতেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং বন্যার অভিঘাতে বিধ্বস্ত সাধারণ পাক নাগরিকেরা দাবি তুলেছেন, হিন্দুস্তানের সঙ্গে বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ায়। দাবি তুলেছেন, কাশ্মির কাশ্মির করে গলাবাজি না করে দু-দেশের মধ্যে ফের বাণিজ্য শুরু হোক।  

আসলে পাকিস্তানের আর্থিক দুর্দশা এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে কাশ্মির দেখিয়ে বাঁচার উপায় নেই। নওয়াজ মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারতের যে সাফল্য তুলে ধরেছেন গোড়ায় তাতে সামান্য হলেও পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। ১৯৬০-এ তারা প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করে। কিন্তু ১৯৯০-এর পর আর অগ্রসর হতে না পারার কারণ মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাথাতেও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তাদের বসানো হয়। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তাই। ফলে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে উদ্ভাবনের পরিবর্তে পাকিস্তান তখন থেকে শুধুই ক্রেতা।

নওয়াজ ভারতের সঙ্গে তুলনা টেনে নিজের দেশ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, লজ্জার মুখ ঢাকার উপায় নেই বলেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ পাড়েননি। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭৫, বাংলাদেশের মুক্তির ৫০ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষকে সামনে রেখে তিন ভূখণ্ডের নাগরিকেরা কেমন আছে তা বোঝার চেষ্টা এখনও জারি আছে।

আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তানের অন্দরে এই চর্চা তুলনায় বেশি। কারণ, সে দেশের দুর্দশা আজ গোটা বিশ্বের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই ধর্মের ভিত্তিতে সুজলা-সুফলা পৃথক দেশ পাওয়ার স্বপ্ন জোর ধাক্কা খেয়ে যায়। আর ১৯৭১ পরবর্তী ৫০-৫১ বছরে পাকিস্তান শুধুই পিছিয়ে গিয়েছে, এগিয়েছে বাংলাদেশ।  

প্রখ্যাত দুই অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জেআর পারকিনসন তাদের ১৯৭৬ সালে লেখা ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে বলেছিলেন,  ‘উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ। দেশটি যদি উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনও দেশই উন্নতি করতে পারবে।’

বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি ভঙ্গুর এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ছিল তুমুল অশান্ত। চরম হতাশা, অনিশ্চিয়তা গ্রাস করেছিল আট কোটি মানুষকে। একদিকে দারিদ্র, খাদ্যাভাব, অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংঘাত—সব মিলিয়ে ওলটপালট অবস্থা। ফলে বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়ায় একটি বিশাল ভিক্ষার ঝুলি। তার জাতীয় বাজেটের ৯০ ভাগই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ ঠিক কোন অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইংরিজি দৈনিক ডন পত্রিকায় সেদেশে পদার্থবিদ্যার নামি অধ্যাপক পারভেজ হুদভয় তার ‘হোয়াই বাংলাদেশ ওভারটুক পাকিস্তান’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জন্মকালে দেশটির এমন অবস্থা যে একজনও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলা পর্যন্ত ছিলেন না।’

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্যাবিনেট সচিব প্রয়াত এইচটি ইমাম ক্যাবিনেট সচিব হিসাবে কাজের দিনগুলি স্মরণ করতে গিয়ে দক্ষ অফিসারের অভাবের কথা বলেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান বহুজনকে ডেকে নিয়ে অনুনয় বিনয় করছেন প্রশাসনে যোগ দেওয়ার জন্য। কারণ, বাঙালিদের দাবিয়ে রাখা যাবে না, বুঝতে পেরে পাকিস্তানের পশ্চিমি কর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পথঘাট-সেতু-স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-রেল স্টেশন ধ্বংসের পাশাপাশি মানবসম্পদকেও নির্মূল করে দিতে চেয়েছিল তারা।

সেই বাংলাদেশের অগ্রগতিকে মেনে নিয়ে জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জেআর পারকিনসন ২০০৭-এ ফের লেখেন, ‘তিন দশক পর বলাই যায় বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।’ বাংলাদেশের এই অগ্রগতির একটি কারণ অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অগ্রনী ভূমিকা।  সামগ্রিক উন্নয়নের যে কোনও মানদণ্ডেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হলো সাফল্যের প্রথম সোপান। তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত মাথাপিছু আয়। মাথাপিছু গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বাংলাদেশের ভারতকেও ছাপিয়ে যাওয়ার পেছনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সাফল্য একটা কারণ তো বটেই। ১৯৮০ থেকে ২০০৭, এই সময়কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ছবিটা কিন্তু এমনটা ছিল না। বরং পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশিদের মাথাপিছু আয় কম ছিল। তারপর গত দেড় দশকে চমকপ্রদ উন্নয়নের রহস্যটা তাহলে কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রাকে দুটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া দরকার। প্রথম পর্বটি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০। আগের দশ বছরকে বাদ রাখার কারণ ওই দশকের শুরুতে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর শিশুর মতো স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরবর্তী হিংসা দীর্ণ পরিস্থিতি। নয়ের দশকের শুরু, বিশেষ করে মাঝামাঝি সময় থেকে সিভিল গভর্নমেন্টের সময়ে এসেই জাতীয় উৎপাদনে বাংলাদেশ ছাপিয়ে যায় পাকিস্তানকে। এর সুফল ধরা পড়ে ২০১১-তে প্রকাশিত রাষ্ট্রসংঘের মানবন্নোয়ন রিপোর্টে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং অসাম্য দূরীকরণে আগের কুড়ি বছরের অগ্রগতির নিরিখে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরের বছরে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকাশিত রিপোর্টে উন্নয়নের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে জনসংখ্যাকেই বড় বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশের সাফল্যের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক তথ্যটি হলো পাকিস্তানের তুলনায় জনসংখ্যা প্রায় চার কোটি কম। বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি আর পাকিস্তানের ২১ কোটি।

এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? অন্যতম কারণ গোড়া থেকেই সে দেশের জাতীয় সম্পত্তি অল্প সংখ্যক লোকের হাতে কুক্ষিগত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগের ২৪ বছর যে অব্যবস্থার শিকার হতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাসিন্দাদের।

পাকিস্তানে যারা জোতদার তারাই আবার শিল্প-কারখানা, ব্যাংক-বীমার মালিক, তারাই আমদানি-রফতানির মালিক, আবার তারাই সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক আমলা। ফলে পাকিস্তান দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত—একটি ধনী এবং আরেকটি গরিব। সে দেশে মজবুত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। কোনও একটি দেশে মধ্যবিত্ত না থাকলে শিল্পপণ্যের বা কৃষির বাজার গড়ে ওঠে না, বহুমুখী উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে না। সামাজিক গতিশীলতা দেখা যায় না।

এই শূন্যতার রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না, জনগণের শাসন যে সামান্যটুকু সম্ভব তাও টিকে থাকে না। জন্মের ৭৫ বছর পর বলা চলে পাকিস্তানে রাষ্ট্র আছে, উপযুক্ত নাগরিক নেই, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে দেশের সাধারণ নাগরিক একাধারে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা।

দ্বিতীয় সমস্যাটি সামাজিক কাঠামোগত। কতিপয় ধনীর কবলে থাকা দেশটিতে শ্রেণি সংগ্রাম নেই। সেখানে এক ধরনের প্রচলিত প্রাচীন আনুগত্য (প্রিমর্ডিয়াল লয়্যালটি) বিরাজ করছে। সেখানে ব্যাপকভাবে ভূমি সংস্কার, সম্পত্তি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, সম্পদের ওপর কর আরোপ, সামাজিক গতিশীলতা নিশ্চিত করা, সকল প্রদেশের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, নাগরিকদের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে এবং নারীদের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নিশ্চিত না করলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে আরও পিছিয়ে যাবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে সে পরিবর্তন আনার জন্য অনেক বেশি সৃজনশীল হতে হবে।

সেই পথে না হেঁটে পাকিস্তান বিগত ৭৫ বছর ধরে শুধু হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে গেলো। কারগিল যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে নওয়াজ নিজেও যুদ্ধবাজদের তালিকায় নাম তুলেছেন।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজেরই ভূখণ্ডে মুখ থুবড়ে পড়ে পাকিস্তান। জন্ম নেয় বাঙালির রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেটি একই সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের তৃতীয় যুদ্ধ। পরাজয়ের পর ক্ষিপ্ত জুলফিকার আলি ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানিদের সান্ত্বনা দিতে বলেছিলেন, হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ হাজার বছর চলবে।

ফলে যুদ্ধবাজ দেশটি চলে গিয়েছে সেনার কবলে। তাই ৭৫ বছরে সে দেশে একটি সরকারও পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। অন্যদিকে, ভারতের বর্তমান সরকার প্রায় দশ বছর ক্ষমতায়। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বয়স পনেরো পেরতে চলল।

লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক ও বাংলাদেশ বিষয়ক পর্যবেক্ষক; এক্সিকিউটিভ এডিটর, দ্য ওয়াল