জামায়াতের কেয়ার অফ-এ আন্দোলন?

অসফল আন্দোলনের মোড় ঘুরাতে পাকিস্তানপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চে যাচ্ছে বিএনপি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি আছে মাত্র। এতদিন যুগপৎ আন্দোলনের নামে জামায়াতের সঙ্গী বিএনপি এখন একান্নভুক্ত পরিবারের মতো রাজনীতিতে নামছে। বিএনপির অতীত রাজনীতির দৃষ্টান্ত তুলনায় এই উদ্যোগকে অভিনব বলার সুযোগ নেই। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের সঙ্গী বিভিন্ন দলের আদর্শিক লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে বড় রকমের প্রশ্নবোধক চিহ্ন সামনে চলে আসে। বর্তমানে বিএনপির সহযোগী কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সখ্য গড়েছে জামায়াত-বিয়োগের শর্তে। এই দলগুলোর কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করারও প্রমাণ আছে। ক্ষুদ্র হলেও এই মুহূর্তে রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পাওয়া গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূরের রাজনৈতিক উত্থানই হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন মাধ্যমে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে গণফোরামের ড. কামাল হোসেন বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেছিলেন জামায়াত মাইনাস শর্তে। জুনায়েদ সাকিদের দলের সঙ্গে জামায়াতের আদর্শিক বিরোধ স্পষ্ট। এমতাবস্থায় বিএনপির ‘লন্ডন নির্দেশনা’ হিসেবে আলোচিত জামায়াত-বিএনপি মঞ্চ তাদের যুগপৎ আন্দোলন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা দেখার বিষয়।

বিএনপির নতুন পরিকল্পনা সরাসরি লন্ডন থেকে তারেক রহমান নিজে করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। সেক্ষেত্রে বিএনপির ভিতরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতৃবৃন্দ এই নির্দেশ কতটুকু পালন করবেন সেটিও দেখার বিষয়। এই মুহূর্তে বিএনপি নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে এটা বাস্তবতা। তাদের সিনিয়র নেতাদের প্রায় সবাই এখন কারাগারে। না হয় আত্মগোপনে। আত্মগোপনে থেকেই দলীয় কর্মসূচি পালনে তারা নিয়ামক ভূমিকা পালন করছেন। জামায়াতবিরোধী এই নেতারা এখন আত্মরক্ষার উছিলায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

পরিস্থিতির কারণেই বিএনপির এই উদ্যোগ প্রশ্নের মুখে পড়ে। যদি জামায়াতকে তারা এক মঞ্চে নিয়ে আসে তাহলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাদের অবস্থানটি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তারা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আগে যখন আন্দোলন করেছে তখন তারা বলেছে, জামায়াত যে অপরাধী সংগঠন তার আইনগত ভিত্তি নেই। অর্থাৎ তারা আদালত মাধ্যমে অপরাধী সাব্যস্ত হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে জামায়াত সর্বোচ্চ আদালত মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী দল হওয়ায় নিবন্ধন অযোগ্য বলে ঘোষিত হয়েছে। যে কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী নির্বাচনসমূহে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে নির্বাচনের অধিকারও হারিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতকে আদালত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণাও করেছে। শুধু তাই নয়, বিদেশেও জামায়াতকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে একাধিকবার আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন অবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে এবং আদালতের মাধ্যমে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ও যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকে একই মঞ্চে আনার মাধ্যমে বিএনপি আবারও বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ করছে, এ সম্পর্কে দ্বিধা থাকার কথা নয়।

বিএনপির ছাতার নিচে জামায়াতের আশ্রয় হলে জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে কোন দলটি কী সুবিধা লাভ করবে সেই বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন না হলে বিএনপির সিনিয়র নেতারা শিগগিরই কারামুক্ত হতে পারবেন না বলে অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে আভির্ভূত হবে জামায়াত। জামায়াতের উত্থানে বিএনপির তৃণমূল কর্মী-নেতারা কীভাবে দেখবে সেটিও বিবেচনার বিষয়। অন্যদিকে প্রায় নিষিদ্ধ একটি দলের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলও কী দাঁড়াবে সেটিও দেখার বিষয়।

জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ বলার সুযোগ পাবে- এই আন্দোলন করছে স্বীকৃত সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত। চলমান আন্দোলনে সন্ত্রাসী জামায়াতের নামটি চলে আসবে সবার সামনে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ পাবে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সংবাদটি প্রকাশ হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে ৬ নভেম্বর। সংবাদ অনুযায়ী স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যও এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছেন, ‘কেন জামায়াতকে টেনে আনা হচ্ছে একমঞ্চে। গত পাঁচ বছর ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি যে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ দাঁড় করিয়েছে, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে কার লাভ?’ নেতাদের কেউ কেউ এই পদক্ষেপের পেছনে সরকারের হাত থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন। আন্দোলনে বিএনপির যে ইমেজ তৈরি হয়েছে তাকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যেও এমনটা করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও তাদের সন্দেহ। কেউ কেউ এই উদ্যোগকে সরকারের ঘরে ফসল তুলে দেওয়ার শামিল বলেও মন্তব্য করেছেন।

বিএনপির আন্দোলনের অংশীদল গণতন্ত্র মঞ্চ ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চে তারা বসতে নারাজ। এক্ষেত্রে যুগপৎ আন্দোলন ভিন্নপথে পরিচালিত হবে। গণফোরামের একাংশের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী পুরো বিষয়টিকে রহস্যময় বলে মন্তব্য করেছেন।

জামায়াতের সামনে এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। অন্য দলের ভিতরে ঢুকে গিয়েও যদি তাদের টিকে থাকা সম্ভব হয় তাহলেও তারা করবে। কিন্তু সুফল নিয়ে তারা নিশ্চিত নয়। কারণ, তাদের দুর্দিনে বিএনপিকে তারা সঙ্গে পায়নি। এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই বিষয়ে তাদের সমালোচনাগুলো গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সাগরে ভাসা কাঠের টুকরায় ধরে বেঁচে থাকার প্রয়াস নিতেই পারে তারা।

প্রশ্ন হচ্ছে, সেই অবস্থায় সরকার তাদের জন্য আদৌ দরজা খোলা রাখবে কিনা।

সরকার যদি জামায়াতকে আরও কোণঠাসা করার নীতি গ্রহণ করে, অন্যদিকে বিএনপি জোটের শরিকরা যদি বিএনপি থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে তাদের আন্দোলন কী মুখ থুবড়ে পড়বে না? কারণ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির একাধিক শরিক দল আন্দোলন করবে না। শরিকরা যে আশায় বিএনপির ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করেছিল, সেই আশা পূরণ হচ্ছে না তারা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে। সেই অবস্থায় ছোট দলগুলো নিজেদের পথ দেখবে এবং তারা রাজপথে থাকলেও আন্দোলন বাস্তবে থাকবে না। আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিশেষণ যুক্ত হবে তখন- তা হচ্ছে আন্দোলনের শরিকদেরও তারা ধরে রাখতে পারছে না। এমনটা বিএনপির রাজনীতির জন্য আরেকটি ধস হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

সেক্ষেত্রে আন্দোলনের ফসল যাবে জামায়াতের ঘরে। বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো নেতৃত্বশূন্যতাকে আরেকবার প্রমাণ করবে।    

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক