ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়

ইসরায়েলের শক্তির দম্ভে আঘাত হেনেছে ইরান। ১৩ এপ্রিল এক রাতে ইসরাইলে ড্রোন ও মিসাইল হামলা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, চোরের ১০ রাত আর গৃহস্থের ১ রাত। এতদিন ইসরায়েল নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য শুধু গাজায়ই নয়, ফিলিস্তিনের সমর্থক মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বহুবার হামলা করে নিজেকে ওই অঞ্চলে মহাশক্তিধর প্রমাণের চেষ্টা করেছে। ফিলিস্তিনি নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করার পরও বিশ্বসমাজ তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারেনি। এমতাবস্থায় তাদের বড় শত্রু ইরানও তাদের কিছুই করতে পারবে না—এমন ভাবনাই ছিল তাদের।

ইরানের হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাদের বড়মাপের অর্থ খোয়াতে হয়েছে, যা ইরানের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি বলে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের বক্তব্য অনুযায়ী, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তারা আকাশেই নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে, যে কারণে তাদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। অর্থাৎ তাদের কথা অনুযায়ী এই হামলায় ইরানের চেয়ে ইসরায়েলের সাফল্যই বেশি। যে মুহূর্তে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীপরিষদ বিশেষ বৈঠক করছিল তার আগেই ইরান ঘোষণা দিয়েছে তারা আর আক্রমণ করবে না। যদি ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ করে তখন তারা আর ছাড় দেবে না।

ইরানের এক রাতের হামলায় পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবাই উদ্বিগ্ন রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র এখানেও তৈরি হয়ে যায় কিনা। আমেরিকা ইসরায়েলের জানিদোস্ত হওয়ার পরও স্পষ্ট হুঁশিয়ার করে জানিয়েছে ইরানকে যেন পাল্টা আক্রমণ না করা হয়। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের পাশে থাকবে না। ইউরোপ আমেরিকার যেসব দেশ থেকে ইসরায়েল অস্ত্র সহযোগিতা পেয়ে থাকে কিংবা যেসব দেশ ইসরায়েলে অস্ত্র রফতানি করে থাকে তারাও সতর্ক বার্তাই দিয়েছে। তারা একপক্ষীয়ভাবে ইরানকে অনুরোধ করেছে আর কোনও হামলা যেন ইসরায়েলকে না করে।

ইতোমধ্যে সংবাদ হয়েছে, ইসরায়েলে হামলা শুধু ইরান থেকেই করা হয়নি। একাধিক এশীয় দেশ নাকি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় অংশ নিয়েছে। এই তথ্য সত্য হয়ে থাকলে ইসরায়েলকে নিজেদের রক্ষার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। এই পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস ছিল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সবাই ইসরায়েলের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও তারা কিছুই করতে পারবে না। এমনকি তাদের দৃশ্যমান শত্রু ইরান বিষয়েও তাদের ধারণা ছিল, ইসরায়েলের কোনও স্থাপনা কিংবা তাদের লোকজনের কোনও ক্ষতি তারা করতে পারবে না। বাস্তবে কী দেখা গেছে, ১০০ কোটি ডলার খসে গেছে ইসরায়েলের ইতোমধ্যে। যেখানে ইরানের ব্যয় এর এক-দশমাংশ মাত্র।

ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতায় ইরানের ড্রোন হামলা আকাশেই প্রতিহত করা অনেকাংশে সম্ভব হয়েছে। তারপরও ইসরায়েলের দুটি বিমান ঘাঁটিতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাকেও কম বলার সুযোগ নেই। আসলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে তাদের হিসাবনিকাশে যে চিড় ধরিয়েছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। এতদিন তারা হামাসকে দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ব্যর্থ হয়েছে, মূলত ইরানের সহযোগিতার কারণে। তারপরও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর তারা যদি হামাস দমনের চেষ্টার পাশাপাশি নতুন সরাসরি শত্রু হিসেবে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায়, সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

অর্থসম্পদের হিসাবের চেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, ইরানের এই হামলা ইসরায়েলের বন্ধু এবং সাহায্যকারী দেশগুলোর মানসিকতা। হয়তো ইরানও বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পেরেই এই সময়টাকে হামলার জন্য উপযুক্ত মনে করেছে। তারা হিসাব করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। ওই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। গাজায় সহিংসতা চালানোর ক্ষেত্রেও ইসরায়েলের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এমতাবস্থায় ইরানের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া তাদের জন্য সুখকর হবে না, এটাই তারা চিন্তা করছে। যার প্রতিফলনও দেখা গেছে ইতোমধ্যে। যে কারণে জো বাইডেন ইসরায়েলকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তারা যেন ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে না যায়।

ইসরায়েলের মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলোর সুরও অনেকটা জো বাইডেনের মতোই। আসলে সবাই যুদ্ধের পরিণতিতে নিজেদের অর্থনীতিতে আঘাত আসুক এটা চায় না। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ইসরায়েলকে বলেছে যুদ্ধের দিকে যেন দেশটি না যায়।

এই বক্তব্যগুলো কিন্তু ইরানের হামলার যথার্থতা হিসেবেও গণ্য হতে পারে। কারণ সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলাটি ছিল ইরানকে হামলার দিকে উসকে দিয়েছে। এই ভাবনা ইরানের কৌশলগত বিজয় বলেও গণ্য হতে পারে।

এতদিন ইরান হামাস ও হুতিদের সহযোগিতার মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও সরাসরি হামলার ঘটনা এটিই প্রথম। প্রথম আঘাতের সময়টি মূলত ইরানের পক্ষে ছিল। তাৎক্ষণিক হামলা বন্ধের ঘোষণাটিও ইরানের ইতিবাচক কৌশল হিসেবে গণ্য হতে পারে। না হলে বিশ্বমোড়লরা ইরানকে আহ্বান জানাতো যুদ্ধ বন্ধ করতে। তারা নিজেরাই ঘোষণা দিয়ে হামলা দীর্ঘায়িত না করে মোড়লদের মোড়লগিরি করার সুযোগ দেয়নি।

ইতোমধ্যে ইসরায়েল প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেছে। তবে সেই ধমকটা খুব একটা উঁচুস্বরের নয় তাও নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তেই বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ইরান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলবিরোধী কয়েকটি দেশ নেতানিয়াহুর ধমককে নতুন করে দেখছে না। তাদের কাছে নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েল বরাবরই ধমকের অপর নাম।

সমরবাজ ইসরায়েলের দিন-বছর যায় যুদ্ধে যুদ্ধে। হয়তো সেই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আচমকা কোনও হামলা কোথাও করেও বসতে পারে। প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টিকে যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো হালকাভাবে নেয়নি তাও অনুমান করা যায়। এদিকে ইরান যুদ্ধে যায়নি বলে যে বসে থাকবে তেমনটাও নয়। তারা বলে দিয়েছে ইসরায়েল যদি এরপরও কোনও হামলা করে তাহলে দাঁতভাঙা জবাব দিতে তারা প্রস্তুত।

ইসরায়েলে ইরানের হামলা বন্ধের ঘোষণার কারণে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে আর উত্তেজনা ছড়ানোর মতো কোনও ঘটনা ঘটবে না। যুদ্ধবাজ ইসরায়েল সুযোগ পেলে ফিলিস্তিনের বাইরে আবারও কোথাও না কোথাও হামলে পড়তে পারে। হয়তো সব দেশই প্রতিরোধের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। তারা হয়তো চুপ করে আছে যুদ্ধের পরিণতির কথা ভেবে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক