গণ-অভ্যুত্থানের মোড়লিপনা

৫ আগস্টের পর দেড় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো মাত্রায় সচল নয়। এরইমধ্যে সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতা কেবল প্রয়োগ করতে পারবেন সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ছয়টি খাতে সংস্কারের ঘোষণা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমানে এর কোনও কোনোটিতে আবার এসেছে রদবদল। তবে কোনও ক্ষেত্রেই এখনও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি।

শুধু ব্যক্তিদের পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। সেই পরিবর্তনেও সংস্কারের কোনও লক্ষ্য নেই। এই পরিবর্তন হচ্ছে মূলত ‘লিস্ট’কে ঘিরে। বিএনপি লিস্ট দিচ্ছে, দিচ্ছে জামায়াত। আবার ‘ছাত্রদের’ কাছ থেকেও লিস্ট এসেছে, আসছে।

এই লেখা যখন লিখছি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দেড় মাস পরও খোলা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মূলত এখনও খোলেনি ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এক এজেন্ডায় সম্পন্ন হওয়া সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে ২২ সেপ্টেম্বর। তার আগেই ঘটছে মব হত্যা। মব জাস্টিস নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। এখন আমাদের খুঁজতে হবে এই ধরনের প্রবণতার কারণ কী? কেন এগুলো থামানো যাচ্ছে না।

যদিও এই অভ্যুত্থান জুলাইয়ের ২০২৪-এর অভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিত, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের শোষণ, নিপীড়ন আর নির্মমতার অভিজ্ঞতা। তারা তখন প্রশাসনের কাছে তাদের ন্যায্যবিচার পায়নি। তাদের প্রতি যে বৈষম্য জারি রাখা হয়েছিল সেগুলো তারা মিটিয়ে নিতে চায়। সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে  তারা মব জাস্টিস চর্চা করে আসছিল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলের নিপীড়ন এবং অসম্মান কিছুতেই ভোলার নয়। তাই তাদের ক্ষোভ খুব অল্প সময়েই প্রশমিত হবে, এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু তাদেরও স্মরণে রাখতে হবে, যে স্লোগানটি সবসময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ- লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করেই জিততে চাই’, সেই জেতা আক্ষরিকভাবে দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেটি কোনোভাবেই প্রতিশোধ নিজের হাতে নেওয়ার মতো মোড়ল হয়ে উঠতে শেখায় না।

আমাদের মনে রাখতেই হবে, এই গণ-অভ্যুত্থান নিশ্চিতভাবেই ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থান, কিন্তু আদতে সেখানে এখন আর কেউ জনতার কথা বলছে না। সবই এখন ‘ছাত্র’রা নির্ধারণ করছেন। ‘জনতা’র কাতারে কারা ছিল, তারা এখন কোথায়, তা কেউ খোঁজ করছেন না। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত বলেছেন, তাদের ক্ষমতায় এনেছে ছাত্ররা। তাই আমরা দেখেছি সচিবালয়ে অবরুদ্ধ থাকা থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই ছাত্র মবের সহযোগিতা চেয়েছে উপদেষ্টারা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও এই মবই আসলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সবাই ভয় পাচ্ছে এই মবকে।

‘ছাত্র’ পরিচয়টি যেখানে একটি অতি বৃহৎ ঐক্য তৈরি করতে পেরেছিল, সেই পরিচয়টি এখন কেন ‘ভয়ের’ প্রতীক হয়ে উঠছে।

এর কারণ আন্দোলনের গৌরবানায় রয়েছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি। যার প্রভাবে উপদেষ্টা পরিষদেও আমরা শ্রমিক শ্রেণির কোনও প্রতিনিধি দেখতে পাইনি। এই আন্দোলনে শ্রমিক, মজলুমরা যোগদান এবং জীবন দিয়েছে। তারা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে। কিন্তু সত্যি হলো যে কারও আলোচনাতেই তারা নেই। তাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত কেউ কোনও ধরনের আলোচনায় বসেননি। আমি নিশ্চিত, একেবারেই নিশ্চিত তাদের অনেকেই হয়তো ফ্যাসিবাদ, কমপ্লিট শাটডাউন, রিমেমবারিং আওয়ার হিরোজ’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত না, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা তাদের নিয়ে এসেছিল রাজপথের অভ্যুত্থানে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের মোড়লিপনা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। সেখানে ‘ছাত্র’ পরিচিতি যেমন আছে, তেমনি আছে ‘এলিট গোষ্ঠীর’ হম্বিতম্বি। সেখানে সাধারণ মানুষের স্বর খুবই কম। আগে আওয়ামী কর্তৃত্ববাদী সরকার সরকারবিরোধী কোনও আন্দোলন হলেই ‘জামায়াত-বিএনপি’ তকমা দিতো, এখনও আন্দোলন হলেই তকমা পড়ছে ‘আওয়ামী লীগ’ বা কোন এক ধরনের লীগ। আমাদের এই দ্বি-বিভাজিত অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি আদৌ নেই?

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুসারে, ‘ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে ১৬ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৭৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই গুলিতে মারা গেছেন। এছাড়া এই আন্দোলনে আহতের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি’। বিএনপি দাবি অনুযায়ী ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে তাদের ৪২২ জন শহীদ হয়েছেন। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এই আন্দোলন কত শ্রমিক শহীদ হয়েছেন এবং কতজন আহত হয়েছেন সেটি আমরা এখন পর্যন্ত জানি না। এই আন্দোলনে বাম-ডানপন্থি সবাই ছিল, কিন্তু প্রায় সবাই আন্দোলন নিয়ে নিজেদের গৌরব প্রচার এবং অন্যকে ‘নাই’ করে রাজনীতিতে কম বেশি ব্যস্ত। এবং আমরা সেগুলো নিয়ে খুব বেশি বিচলিতও নই। মজার বিষয় হলো, যখন পদায়নের ক্ষেত্রে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে, তখন এই আন্দোলন নিয়ে মোড়লিপনা আরও বেড়ে যাচ্ছে।

আমাদের সতর্ক থাকতে হবে অনেক বিষয়েই। শিক্ষার্থীরা আমাদের গর্ব। তারা সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা যেভাবে বন্যাপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের আগলে রাখতে দায়িত্ব পালন করেছে, সেটিও নজিরবিহীন। কিন্তু শিক্ষার্থীরাই ক্ষমতায় এনেছে বলে তাদের সব অন্যায় এবং অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে কথা বলা যাবে না বা জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করা যাবে না, সেটি কেন?

আন্দোলনের কৃতিত্ব সবাইকে দিতে হবে এবং এটি করতে না পারার কারণেই আসলে মব জাস্টিস বেড়ে যাচ্ছে। কারণ আমরা অন্য সময়ের মতো এবারের আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপনেও কিছু  গোষ্ঠী এবং শ্রেণিকে প্রাধান্য দিচ্ছি এবং এক ধরনের দেবত্বারোপ করছি, যা বিগত সরকারও করেছে। আমরা হয়তো সবাই কম বেশি ফ্যাসিবাদ মনস্ক। অন্যেরটা নিয়েই সবসময় কথা বলতে পছন্দ করি এবং নিজেরটাকে ‘যৌক্তিক’ হিসেব হাজির করাই। এর এভাবে আমাদের মধ্য দিয়েই বারবার উৎপাদিত হয় রোমান্টিসাইজড ইতিহাস এবং এর নায়কেরা।

আন্দোলনের মোড়লিপনা বন্ধ করা খুবই দরকার। কোনও এক গ্রুপ বা দলকে যদি অতিমাত্রায় ‘মহামান্বিত’ করেন, তাহলে দেখবেন আপনি আমি এভাবেই ফ্যাসিবাদকে বারবার লালন করছি এবং ভয়ের সংস্কৃতি থেকে আর মুক্তি মিলছে না। অথচ এই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল ভয়কে জয় করেই এবং সেটি স্থায়ী করার জন্যই।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

zobaidanasreen@gmail.com