ভূতটা সর্ষের মধ্যেই!

প্রভাষ আমিনবাংলাদেশের ৮০০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কিছু টাকা গেছে শ্রীলঙ্কায়। বেশিরভাগ টাকা গেছে ফিলিপাইনে। সেখান থেকে ক্যাসিনো হয়ে নাকি হংকং চলে গেছে। টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে সবাই আশাবাদী। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ধার হলেও ৪/৫ বছর লাগবে। তবে আমি অত আশাবাদী নই। হয়তো দায়ীদের চিহ্নিত করা যাবে, তৎপর হলে শাস্তিও দেওয়া যাবে। কিন্তু টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা জানি না, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে, টাকা একবার হাতবদল হলে ফিরে পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশে হুন্ডি কাজল থেকে শুরু করে যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, শেয়ারবাজার- কোনও টাকাই ফিরে পাওয়া যায়নি। হাজার হাজার অসহায় প্রতারিত মানুষের বোবা কান্না এখনও গুমরে ফেরে বাতাসে। সমস্যাটা এতদিন ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের, এখন শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয় লুটের এবং তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের।
ক’দিন আগে এটিএম জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর এবার তো রীতিমত কাঁপাকাঁপি দশা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা জুয়ার টেবিলে চলে গেছে। কী ভয়ঙ্কর! আগে মানুষ ঘরে টাকা রাখতো। অল্প টাকা হলে মাটির ব্যাংকে, বেশি হলে সিন্দুকে। পরে ব্যাংক টাকা রাখার নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করে। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড আসার পর সবাই আরও নিশ্চিন্ত হন, যাক এখন আর কাগজের টাকা বহন করতে হবে না। প্লাস্টিক মানি মানে স্মার্ট কার্ড নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করা যাবে। কিন্তু ছিনতাইকারীরা ওভারস্মার্ট। তারা লোকজনকে ধরে এটিএম বুথে নিয়ে অস্ত্রের মুখে পাসওয়ার্ড দিয়ে টাকা তুলিয়ে নিয়ে যেতো। আর এখন তো স্কিমিং মেশিন বসিয়ে গ্রাহকের তথ্য চুরি করে তার অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেয় জালিয়াতরা। আর এখন নিছক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নয়, রাষ্ট্রের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়ার উদ্যোগ। লোকজন আবার মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার কথা ভাবতে শুরু করেছে।
এটিএম জালিয়াতির পর একটা জিনিস পরিষ্কার, বাংলাদেশ যতটা ডিজিটাল হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা ততটা শক্ত হয়নি। অধিকাংশ ব্যাংকই ইচ্ছামত ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সার্ভিস চালু করেছে। যেখানে সেখানে এটিএম বুথ বসিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্যও যে বিনিয়োগ দরকার সেটা তাদের মাথায় আসেনি। তাই আইটি খাতে সার্ভিস অনেক বেশি হলেও লোকবল ছিল এবং আছে একেবারেই কম। তাই তো দেশি-বিদেশি চক্র মিলে গ্রাহকদের টাকা তুলে নিয়েছে। তবে এটিএম কেলেঙ্কারি থেকে একটা ব্যাপার আবারও পরিষ্কার হয়েছে, ভূতটা সর্ষের মধ্যেই আছে। ব্যাংকাররা জড়িত না থাকলে এ ধরনের জালিয়াতি সম্ভব নয়। এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমি অত প্রযুক্তিবান্ধব নই। তাই কীভাবে সুইফট কোড পাঠিয়ে নিউইয়র্ক রিজার্ভ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ লোপাটের ব্যবস্থা হয়েছিল, তার কারিগরি ব্যাখ্যা দিতেও পারবো না, বুঝতেও পারবো না। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি, জালিয়াতরা বেশ আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছিল।

যে ছিদ্র তারা করেছিল, পচা শামুকে পা না কাটলে রিজার্ভ তারা ফাঁকা করে দিতে পারতো। অনেকদিন ধরেই জালিয়াত চক্রটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। তারপর বাংলাদেশের দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে শুক্র-শনি-রবি তিনদিনের নিরাপদ সময় বের করেছে। আর জালিয়াতিটা শুরু করেছে ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জিরো আওয়ারে। ৩৫টি অথেনটিক অর্ডার পাঠাতে পেরেছিল তারা। তার মধ্যে পাঁচটি আদেশ কার্যকর হয়। এরপর একটি ইংরেজি শব্দের বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হয়। তাতেই আটকে যায় পুরো প্রক্রিয়া। এ ঘটনায় কারা জড়িত এ নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক লম্বা তদন্ত হবে। দোষীরা নিশ্চয়ই ধরা পড়বে। কিন্তু ঘটনা বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না কেউ এ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই জড়িত আছেন। ভূতটা আছে সর্ষের মধ্যেই।

সন্দেহটা জোরালো হয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের গোটা বিষয়টা চেপে যাওয়ার প্রবণতা দেখে। ঘটনা ঘটার একমাস পর ফিলিপাইনের একটি পত্রিকার রিপোর্টের সূত্র ধরে প্রথম বিষয়টি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসে। আর অর্থমন্ত্রী বিষয়টা জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। এত বড় ঘটনার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান নির্ধারিত সফরে ভারতে গেছেন। সেখানে গিয়ে এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি দাবি করেছেন, বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। কী ভয়ঙ্কর! ঘটনাটি গভর্নরের প্রথমেই অর্থমন্ত্রীকে জানানো উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে জানানো না জানানোর দায়িত্ব তার নয়। তারপরও প্রধানমন্ত্রীকে জানানোটা আবশ্যিক নয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে জানানোটা আবশ্যিক। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তের স্বার্থেই তারা অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাননি। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারে তারা ভেবেছেন, অর্থমন্ত্রী যেখানে হাজার কোটি লোপাটকেই তেমন কিছু মনে করেন না, সেখানে শত কোটি টাকার নয়ছয় হয়তো তার কাছে কোনও ঘটনাই মনে হবে না। এখানে দুটি অপরাধ, একটি হলো রিজার্ভ চুরি। অপরটি হলো চেইন অব কমান্ড তছনছ করে অর্থমন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের অপরাধ আড়াল করতেই গোটা বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছে। বাংলাদেশের উপচে পড়া রিজার্ভের তুলনায়, ৮০০ কোটি টাকা হয়তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু ভয়টা হলো, যম যে বাড়ি চিনলো।

শুরুতেই আশঙ্কার কথা বলেছি, হয়তো অনেক লম্বা সময় ধরে তদন্ত হবে। কিন্তু টাকা ফিরে আসবে কিনা কে জানে। তবে সরকারের উচিত হবে, নিজেদের রিজার্ভের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই সর্ষের ভূতগুলো খুঁজে বের করা, কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। ভুতটা যত বড়ই হোক।

probhash2000@gmail.com