এক রাখাল বালকের কান্না

হারুন উর রশীদবাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্যবিদায়ী গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগের আগে কেঁদেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলতে গেলে অঝোরেই কাঁদলেন। আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি সব সময়ই দেশের স্বার্থেই কাজ করেছি।’
ড. আতিউর রহমানের এই কান্না হয়তো অনেককেই কাঁদিয়েছে। কারণ, এখানে আমার ‘ট্রাজেডি’র মূল সংজ্ঞাটি মনে পড়ে গেল। শক্তিমান বা জনপ্রিয় পাবলিক ফিগারের পতনকে ট্রাজেডি বলে—এমনই পড়েছি পাঠ্যপুস্তকে। আর এই শক্তিমানের পতনে সাধারণ মানুষও আবেগে দ্রবীভূত হন, সমব্যথী হন। এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
তবে প্রাচীন গ্রিসে ট্রাজেডির শুরুটা কিন্তু মানবিক পতন ছিল না। সেটা ছিল পশু জবাই করার শোকাবহ উৎসব। আর সেউ উৎসবে যে করুণ গান গাওয়া হতো, তাই ট্রাজেডির করুণ সুর। কিন্তু কালের বিবর্তনে ট্রাজেডি এখন মানবিক। মানুষের জীবন কেন্দ্রিক। আর সত্যিই শক্তিমান মানুষের পতনে সাধারণ মানুষ আলোড়িত হন আবেগে—বলেন, হায়!
একজন মিনহাজুল শাওন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘চ্যানেল ২৪-এ দেওয়া ড. আতিউর রহমানের সাক্ষাৎকার দেখে আবেগে দুই চোখ ভরে উঠল। গত সাত বছরে একদিনও ছুটি নেননি তিনি! যে টাকা চুরি গেছে, তা তার সন্তানের মতো! তিনি গত সাত বছরে যত কাজ করেছেন, তা কেবল একজন পিতা তার সন্তানের মঙ্গলের যা করেন, তাই করেছেন! এই আতিউর রহমান কথা বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলছেন! কেবল একজন ভালো মানুষই এভাবে কাঁদতে পারেন! জানি না  উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে আর কত অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাবে...!’
আর আমি এতক্ষণ ট্রাজেডি নিয়ে যা বললাম, তার প্রমাণও হয়তো আপনারা পেলেন।
ড. আতিউর রহমান যে দেশের স্বার্থে সব সময় কাজ করেছেন, এটা আমরাও বিশ্বাস করেছিলাম। সরকারও বিশ্বাস করে। তাইতে তাকে রাখাল বালক থেকে গভর্নর করা হয়েছে। তাইতো তাকে এবার একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাকে সম্মান জানানো হয়েছে।  কিন্তু একটি কথা মনে করিয়ে দেই, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪ ফেব্রুয়ারি তার একুশে পদক পাওয়ার আগে। আর এই হ্যাক হওয়ার ঘটনা তিনি তখনও গোপন রেখেছিলেন। ফিলিপাইনের একটি সংবাদপত্রের কল্যাণে একমাস পর ৮ মার্চ তা জানা গেলেও তিনি ছিলেন চুপ। এই রিজার্ভ ডাকাতি নিয়ে যখন দেশজুড়ে হইচই, তখনও তিনি তার প্রেসউইং-এর মাধ্যমে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরপরও দেশবাসী বা সরকারকে কিছু না জানিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি পাড়ি দেন ভারতে। কোনও এক পূর্ব-নির্ধারিত সেমিনারে পেপার পড়তে! বিষয়টি নিরোর বাঁশির মতো। রোম যখন পোড়ে নিরো তখন বাঁশি বাজান। আর আমরা দেখলাম, একজন বিশ্বাস ভঙ্গকারী গভর্নরকে। যিন রাখাল বালক থেকে গভর্নর হয়েছিলেন।

ড. আতিউর রহমান এক মোক্ষম ব্যাখ্যা দিয়েছেন সোমবার বিকেলে ভারত থেকে দেশে ফেরার পর। তবে তার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কৃপা পেতে চেষ্টা করেছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পারেননি। বুধবার সকালে পেরেছেন পদত্যাগপত্র জমা দিতে। তিনি আগে হয়তো ভাবতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্রই চান। কোনও কান্না বা ব্যাখ্যা নয়। নয় কোনও অজুহাত। কারণ ড. আতিউর রহমান যা করেছেন, তা প্রকাশ্য এবং সব্যাখ্যেয়।

তারপরও পদত্যাগের আগে সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বললেন, ‘আমি টাকা উদ্ধারের আশায় বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম, প্রকাশিত হলে এই কিছু টাকাও উদ্ধার করা যেত যেত না।’ হায়রে ড. আতিউর রহমান! সারাদুনিয়া জানে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ১৯ মিলিয়ন ডলার রক্ষা পেয়েছে হ্যাকারদের বানান ভুলের কারণে। আর আপনি তখনও কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন! 

৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা  নিয়ে নেন হ্যাকাররা। টাকা ছাড় হয় ফিলিপাইনের একটি ব্যাংক থেকে। আর হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহার করে ৪ ফেব্রুয়ারি টাকা স্থানান্তরের এডভাইজ পাঠান। এ পর্যন্ত তদন্তে জানা গেছে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ফিলিপাইনের ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরের সঙ্গে-সঙ্গেই বাংলাদেশ ব্যাংক স্বয়ংক্রিয় সংকেত পায়। ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের কর্মকর্তারাও সেই সংকেত পান। এরপরও টাকা আটকানোর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক যখন সন্দেহ করে, তখন তারা  বাকি পেমেন্ট আটকে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়।  তখনও কি ড. আতিউর রহমানেরর ঘুম ভাঙেনি? না তিনি জেগেই ঘুমাচ্ছিলেন? আসলেই তিনি জেগে ঘুমাচ্ছিলেন। কারণ এরপর তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি দলকে ফিলিপাইন পাঠান। ভেতরে-ভেতরে বিষয়টি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ভাবে একমাস কাটিয়ে দেন। যদি ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম ঘটনাটি প্রকাশ না করত, তাহলে তো বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি জানতে পারত না। অর্থমন্ত্রীও অন্ধকারে থাকতেন।

একমাস অন্ধকারে থাকার পর অর্থমন্ত্রী যখন জানলেন, তখন না বুঝেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিলেন, বললেন,  ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও দোষ নাই।’ অবশ্য পরে বিস্তারিত জেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের  ‘ঔদ্ধত্যে’ ক্ষুব্ধ হলেন।

ড. আতিউর রহমান কার স্বার্থে, কী কারণে রিজার্ভ ডাকাতির কথা গোপন রেখেছিলেন, তা এখনও তদন্তের বিষয়। সংবাদমাধ্যমে রিজার্ভ ডাকাতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও তিনি নিশ্চিন্তে হাসিমুখে কেন ভারত গেলেন, তা ভাবার বিষয়। আর ভারত থেকে ফিরে পদত্যাগের আগে সংবাদ মাধ্যমের সামনে কেন কাঁদলেন, তা বোঝার বিষয়।

তবে ঘটনা প্রবাহে এটা নিশ্চিত হয় যে, তিনি রিজার্ভ চুরির পর যা-যা করেছেন, তা পরিকল্পনা মাফিকই করেছেন। তবে পরিকল্পনা কাজে আসেনি। তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। আর এই প্রথম মঙ্গলবার তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগের পর সংবাদ সম্মেলন ডেকে রিজার্ভ ডাকাতির  ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আর সংবাদ সম্মেলনেও তিনি অনেক তথ্য গোপন করেছেন। নিজের সাফল্যের সাফাই গেয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি পরাজিত সৈনিক নই। আমি একটি খোলা বই। আমার কাছে গোপন কিছু নেই।’  এত বড় রিজার্ভ কেলেঙ্কারি গোপন করার পরও ড. আতিউর রহমান যদি বলেন, ‘আমার কাছে গোপন কিছু নেই’, তাহলে বলতে হয়, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়।’

কিন্তু এখন ব্যখ্যা দিয়ে কী হবে? যখন বলার, তখন তিনি বলেননি। যখন প্রকাশ করার দরকার ছিল, তখন তিনি তা গোপন করেছেন। তিনি সরকারের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ করেছেন। তিনি তার পদের যোগ্যতা হারিয়ে পদে টিকে থাকার নানা ফন্দি করেছেন। যুক্তি হারিয়ে কেঁদে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। পদত্যাগ তো সাধারণ ঘটনা, দেশের মানুষের টাকা চোরের হাতে দেওয়ার, চুরি করার বিচার তো এখনও বাকি। আমরা জানতে চাই, দেখতে চাই, বাংলাদেশ ব্যাংক-এর চোরদের। কারণ, এরইমধ্যে এই তথ্য নিশ্চিত যে, হ্যাকারদের সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা কাজ করেছেন। আর সেই চোরদের যিনি রাখাল বালক, তিনি যতই কাঁদুন, তাকে তো আর পদত্যাগেই মাফ করে দেওয়া যায় না!

ক্ষমা করবেন আতিউর স্যার। আপনার কাছে অনেক গিয়েছি। সাংবাদিক হিসেবে যত, তার চেয়ে বেশি আপনার ছাত্র হিসেবে। আপনার রবীন্দ্রভাবনা। আপনার কৃষিভাবনা। আপনার জল-জলার কথা আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনেছি। আপনি আমাকে তুই বলে সম্বোধন করেন। আপনার প্রতিষ্ঠান ‘সমুন্বয়’-এর অফিসে বসেই আমি জাতীয় বাজেট বুঝেছি। আমাকে আলোড়িত করেছে আপনার চিন্তা। কিন্তু আপনার কান্না আমাকে আলোড়িত করেনি। আমার মনে হয়েছে, এক বেচারার কান্না।

কিন্তু আমি আলোড়িত হতাম যদি আপনি রিজার্ভ চুরির পরই কাঁদতেন, সরকারকে জানাতেন, জাতিকে জানাতেন। বলতেন জনগণের টাকা আমি রক্ষা করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো। তাহলে আমি আবারও আপনার প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হতাম।

স্যার, আপনি মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সাহসী বলেছেন, আপনার পদত্যাগকে সাহসী সিদ্ধান্ত বলেছেনে।’ প্রধানমন্ত্রী উদারতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলেছেন। এত কিছুর পরও আপনাকে সম্মান দিয়েছেন। এর জবাবে আপনার কী করা উচিত? দয়া করে ডাকাতদের ধরিয়ে দিয়ে আপনিও প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানান। দেশের মানুষকে সম্মান জানান।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: swapansg@yahoo.com