একটা সাধারণ ধারণা হলো আমাদের সরকারি অফিসে কেউ কাজ করে না। কিংবা করলেও গুণগত মানের কাজ খুব কম। এসব ধারণা অহেতুক নয়। কিন্তু সম্পূর্ণও নয়। কর্মসংস্কৃতি সব জায়গায় সমান নয়। আবার কর্মসংস্কৃতি খারাপ হওয়ার দায় সব ক্ষেত্রে কেবল কর্মীদের নয়। রাজনীতিরও যোগ আছে অনেক ক্ষেত্রে।
এই সংস্কৃতিটা এমন যে, এখানে খুব কম কর্মীই অফিস বা প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে কাজ করেন। আমরা কাজ করি reactive mood-এ , pro-active fashion-এ নয়, অর্থাৎ আমাদের কাজের ধরন প্রতিক্রিয়া ধরনের, আগাম সক্রিয়তা থাকে কম কাজে কর্মে। এই তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখি প্রতিটি স্তরে আমাদের কাজের ধরন reactive, pro-active নয়।
কাজ না করার অভ্যাস থেকে বের হতে সরকারি অফিস-আদালতে কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর তাগিদ মাঝেমধ্যে উঠে আসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে। কিন্তু মৌলিক জায়গায় গলদ আছে এই চিন্তার। ভালো কর্মসংস্কৃতি মানে কি দশটা পাঁচটা অফিসে হাজির থাকা? ঠিক তা নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারিরা কাজটা কতটুকু করেন, কতটুকু মন দিয়ে করেন, কতটুকু উদ্যোগ নিয়ে করেন প্রশ্ন সেখানে।
যেকোনও মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, যার সরকারি অফিসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে শুনবেন প্রায় একই ধরনের সব গল্প। সরকারি অফিসে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ খারাপ। যে ধারণাগুলো পাওয়া যায় মানুষের সঙ্গে কথা বলে, সেসব অনেকটা এমন- সরকারি কর্মীদের একটা বড় অংশ কাজে খুব অবহেলা করেন, সিটে থাকেন না, অফিসে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত কাজে, দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখেন, কোনও প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেন না, প্রচুর ভুল করেন আর টাকা ছাড়া কাজ করেন না।
কিন্তু একথাতো অবশ্যই সত্য যে, আমাদের অনেক সরকারি অফিস আছে, যেখানে দক্ষ কর্মকর্তা আছেন, কর্মচারি আছেন এবং তারা পরিশ্রম করতে সদাই উন্মুখ, অথচ তাদের মূল্যায়ন হয় না। সরকারি দফতরে কর্মী-মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে কর্মীদের শাস্তি বা পুরস্কারের যথার্থ ব্যবস্থা করা এ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই টাকা চুরিতে কে বা কারা কিভাবে জড়িত; হয়তো কোনওদিন জানা যাবে, কিংবা যাবে না। কিন্তু শাস্তি আদৌ কারও হবে কিনা সেটা কেউ জানে না। এর আগে সরকারি দুটি ব্যাংক, সোনালি ও বেসিক ব্যাংকের টাকা হরিলুটের সময়ও দেখা গেলো রাজনীতির সংশ্রব আছে। তাই বেসিক ব্যাংকের চেয়াম্যানের কিছু হয় না, তিনি যা ইচ্ছে তাই করে সন্মানজনক বিদায় পান। হলমার্ক ঘটনায় কোনও এক উপদেষ্টার কিছুই হয় না, কিংবা রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হওয়া পরিচালকরা বহাল তবিয়তে সমাজে থাকেন।
সরকারি অফিসে দুর্নীতি ওপর মহল থেকে নিচের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। ফাইল আটকে টাকা খাওয়ার যে সংস্কৃতি তাতে একজন সৎ কর্মী বিনা লেনদেনে ফাইল ছেড়ে দিলে তার কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে। আমরা এসব গল্প শুনি সরকারি কর্মকর্তাদের মুখেই। এই সমস্যাগুলো সার্বিকভাবে কর্মসংস্কৃতিতে ছাপ ফেলে, ভালো কর্মীদের নিরুৎসাহিত করে। কাজে ফাঁকি, দুর্নীতি, কাজের অভাব, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং দক্ষতার ঘাটতি সবই কর্মসংস্কৃতিতে আমাদের মান নিয়ে ঠেকায় তলানিতে।
সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ ও প্রশাসন, সামাজিক সুরক্ষা, পরিবহন সব ক্ষেত্রে সেবা পেতে ‘বাজারি দাম’ দিতে হয় সেবা গ্রহণকারিকে।
যা বলছিলাম, নিজের মনে করে কাজ করা, সেই সংস্কৃতির জন্মই দিতে পারিনি আমরা। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোনও সংস্কৃতি নেই। ধরেই নেন আমাদের সরকারি কর্মীরা যে তারা করবেন কম, পাবেন বেশি, জনগণও তাদের শুধু দিয়েই যাবে, যা তারা চান। রাজনৈতিক প্রভু যারা ক্ষমতায় বসেন, তারাও এ নিয়ে ভাবেন না। তাদের ভাবনায় থাকে কত দ্রুত কামাই করে সটকে পড়া যায়।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানুষগুলো টের পান না, পেলেও তা গোপন রাখেন। কর্মসংস্কৃতি কতটা নিম্ন মানের হলে, কতটা চৌর্যবৃত্তি মনে পোষণ করলে, এমন বড় একটি ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে, মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে রাখতে পারে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে! এমন একটি ঘটনাতো প্রধানমন্ত্রীকেই জানানো প্রয়োজন ছিলো তাৎক্ষণিকভাবে। পুরোটাই বলে জবাবদিহিতার কোনও স্থান নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক-এ।
আমাদের বিমান-বন্দরের নিরাপত্তা শিথিলতার কথা ব্রিটিশ সরকারের থেকে শুনতে হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আছে কি? কিংবা মালয়েশিয়ায কর্মী নিয়োগ হবে না, এ কথা হঠাৎ করে শুনতে হয় কেন? কেন সেখানে আমাদের দূতাবাস আগাম কোনও সংকেত বা বার্তা পায় না? সব প্রশ্নের উত্তর কর্মসংস্কৃতি। কোথাও কোনও উদ্যোগ নেই। উদ্যম আর উদ্যোগ যা থাকে তা হলো ব্যক্তিগত সম্পদ আর লাভের বিষয়টি প্রতিনিয়ত নিশ্চিত করা।
সমস্যাটা জটিল। পরিসংখ্যান আর ঘটনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কর্মসংস্কৃতি উন্নত করার সদিচ্ছা আসবে কবে?
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি