বাধ্য হয়ে, সৎ সাহস বা স্বেচ্ছায় নয়

গোলাম মোর্তোজাড. আতিউর রহমান একজন সজ্জন মানুষ। প্রায় সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। ছোটদের স্নেহ করেন, বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করেন। অন্য অনেকের মতো আমার সঙ্গেও তার স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক। তিনি গভর্নর হতে যাচ্ছেন, আগে থেকেই জানতাম। গভর্নর হয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও আনন্দিত হয়েছি। মাটি থেকে উঠে আসা মানুষটির যেভাবে গভর্নর পদ থেকে বিদায় নিতে হলো, তা শুধু তার নিজের জন্যেই দুঃখজনক নয়, আমাদের জন্যেও কষ্টকর।
মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে তার কাজ দিয়ে। ব্যক্তি আতিউর রহমান সজ্জন মানুষ, এই পরিচয়ে এক্ষেত্রে মূল্যায়ন করা যাবে না। আতিউর রহমানের সঙ্কটকালে যে কথা বললাম, লিখলাম- সেটা গভর্নর আতিউর রহমানের কার্যক্রম নিয়ে। ব্যক্তি আতিউর রহমানকে নিয়ে নয়।
কোনও একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর প্রায় সবাই তার প্রশংসায় মেতে ওঠে, এটা আমাদের সমাজের রীতি হয়ে গেছে। আমি এমন রীতিতে বিশ্বাস করি না। যিনি যেমন ছিলেন, তার মূল্যায়ন তেমনই হওয়া উচিত।
ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন, এখন অনেকেই তার প্রশংসা করছেন। পদত্যাগ করে তিনি মহান হয়েছেন, এখানে কেউ পদত্যাগ করেন না, তিনি করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন... ইত্যাদি কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তার সময়ে অর্থনীতি ভালো হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে... ইত্যাদি। আসলে কি বিষয়গুলো এমন?
এ প্রেক্ষিতে কিছু কথা।
১. ড. আতিউর রহমান স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে সকাল ৯টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করবেন, এটা ছিল অর্থমন্ত্রীর হুমকি। পদত্যাগ না করলে অর্থমন্ত্রী তাকে অপসারণ করতেন। এর জন্যে অর্থমন্ত্রী সম্মতি নিয়ে রেখেছিরেন প্রধানমন্ত্রীর।

সুতরাং স্বেচ্ছায়, সাহসিকতার সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করেছেন, তথ্যটি সঠিক নয়।

২. গভর্নর হওয়ার আগের শিক্ষক-অর্থনীতিবিদ-এনজিও’র (তার নিজের একটি এনজিও আছে) আতিউর রহমান, আর গভর্নর আতিউর রহমানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। তার এই পরিবর্তন হয়ত তিনি নিজেও পুরোটা বুঝতে পারেননি। ব্যাংকিং না করে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘোরাঘুরি করেছেন বেশি। পদত্যাগের পরে তিনি বলেছেন, নিজের সন্তানদের সময় না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে সময় দিয়েছেন। বাস্তবে তিনি তা করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবেই তিনি ঘোরাঘুরিসহ অন্যান্য কাজে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। যা আসলে গভর্নরের কাজ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের কার্যক্রমে সময় কম দেওয়ায় সবকিছু তার জানা থাকেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা আছেন। অযোগ্য, অসৎ কর্মকর্তার সংখ্যাও অনেক। অসৎ, অযোগ্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি বা নিতে পারেননি। ফলে ভেতরে ‘চেইন অব কমান্ড’ ঠিক ছিল না।

৩. ‘চেইন অব কমান্ড’র সমস্যা তার নিজের ক্ষেত্রেও কার্যকর ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগের সুযোগে তিনি প্রতিনিয়ত অর্থমন্ত্রীকে বাইপাস করেছেন। সর্বশেষ এই অর্থ চুরির সময়ে তা প্রকোটভাবে প্রকাশিত হলো। এটা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বাংলাদেশের প্রায় কোনও প্রতিষ্ঠানের ‘চেইন অব কমান্ড’ ঠিক নেই। তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপের কর্মকর্তারা তার ওপরের দুই তিন ধাপ অতিক্রম করে কথা বলেন। এমন অবস্থা কোথায় কোথায়, কতটা প্রকোটভাবে আছে- তা কমবেশি প্রায় সবারই জানা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকেরটা প্রকাশিত হলো।

৪. ড. আতিউর রহমান অর্থমন্ত্রীকে না জানিয়ে, প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন। তাও জানালেন এক মাস গোপন রেখে, আর যখন গোপন রাখতে পারলেন না তখন। পদত্যাগ করার আগে-পরে যে ব্যাখ্যা দিলেন, তা এক কথায় শিশুসুলভ। ‘জানালেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হতো না’- এই কথা ড. আতিউর রহমান বলছেন, বিশ্বাস হতে চায় না।

এমন যুক্তিহীন যুক্তি দিয়ে তিনি তার ব্যার্থতা  জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। নিজে কাউকে কিছু জানাননি। গণমাধ্যম মূলত বিদেশি সূত্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের সূত্র থেকে তথ্য জেনেছেন। জেনে যারা লিখেছেন, বলেছেন তাদের লেখা- বলা বন্ধ করতে চেয়েছেন আতিউর রহমান। অত্যন্ত দাম্ভিকতার সঙ্গে তিনি তা করার চেষ্টা করেছেন।

৫. পদত্যাগের সময়ে তিনি অনেকগুলো কথা বলেছেন। তার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত আতিউর রহমানের স্বরূপ ফুটে উঠেছে। বলেছেন ‘আমি ছয় সাড়ে ছয় বিলিয়ন থেকে রিজার্ভ আটাশ বিলিয়নে নিয়ে গেছি’ ইত্যাদি। কথা বলতে গিয়ে বারবার ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অবশ্যই সত্যি যে, রিজার্ভ ২৮ বিলিয়ন হয়েছে। কিন্তু এতে ‘আমি’ মানে আপনার এত  কৃতিত্বের কী আছে? কৃতিত্ব তো প্রবাসী কর্মী, রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে। এখানে ‘আমি’ এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এটা ‘আমার’ সাফল্য কেন? আর্থিক নীতিতে এমন বৈপ্লবিক কিছু করা হয়নি যে তার প্রেক্ষিতে রিজার্ভ বেড়েছে।

৬. কমপক্ষে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। তা নিয়ে তো আপনাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেল না। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা, তদন্ত কোনও কিছুই তো করতে দেখা গেল না। রফতানিকারকদের অনেকে যে অর্থের একটা বড় অংশ দেশে আনেন না, তা নিয়ে আপনি তো কিছু করেননি। প্রবাসীদের পাঠানো টাকার কৃতিত্ব আপনার হবে কেন?

৭. পদত্যাগের আগে আপনার গলা কাঁপছে, চোখে পানি। আমাদের অনেকেরই তা দেখে খারাপ লেগেছে, কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু শেয়ারবাজারের লাখ লাখ মানুষের কান্না আপনাকে স্পর্শ করেনি। আপনি মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ ছিলেন, এখন নেই। কত দরিদ্র মানুষ শেয়ারবাজারে সব হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন, আপনি তার খবর রাখেননি।

আপনি আপনার সাফল্যের কথা বলেছেন। ব্যর্থতার কথা আপনি ভুলে গেলেও, মানুষ ভুলে যায়নি। হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১২০০ কোটি টাকা, থার্মেক্সের ৮০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় আপনার ভূমিকা এবং দায়িত্ব কী ছিল, কী করেছিলেন?

আপনার গভর্নর হিসেবে সাত বছরের সময়কালে দেশের আর্থিকখাতে যে পরিমাণ নৈরাজ্য, লুটপাট হয়েছে- তা আর কখনও হয়নি।

৮. আপনি বলেছেন, ভূমিকম্পের মতো আঘাত এসেছে, জঙ্গি আক্রমণের মতো আঘাত এসেছে। ‘পাজলড’ হয়ে গিয়েছিলেন, কি করতে হবে বুঝতে পারেননি। তাতে বিদেশ যেতে সমস্যা হয়নি! ভেতরের কাউকে সন্দেহের আওতায় আনেননি। তদন্ত করেছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ৭ মার্চ বিবৃতি দিয়ে ফেড’র ওপর দায় চাপিয়েছেন। অসত্য বলে নিজের দায় আড়াল করতে চেয়েছেন। আপনি ফোন করে রাকেশ আস্তানাকে আমেরিকা থেকে ডেকে আনলেন। আপনি দেশের কোনও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসলেন না। তারা আপনার পুরো কারিগরি সহায়তা হয়ত দিতে পারতেন না। কী করবেন, কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে হবে, তা বলতে পারতেন। তাহলে আপনি সরাসরি ‘ফায়ার আই’কে নিয়োগ দিতে পারতেন। ‘মিডলম্যান’ রাকেশ আস্তানার মাধ্যমে ‘ফায়ার আই’ পর্যন্ত পৌঁছতে হতো না।

৯. সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের মতো আর্থিকখাতেও একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ড. আতিউর রহমানের বিদায়ের মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তা মোটেই সঠিক নয়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আতিউর রহমান চলে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো চলবে, তা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। এখন অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। সোনালি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এখন চালাবেন বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সোনালি ব্যাংকই ঠিকমতো চালাতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকমতো চালাবেন, ভাবার কারণ নেই।

অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রে যেভাবে ক্ষিপ্ত হলেন, সোনালি, বেসিক, শেয়ারবাজার... প্রভৃতি কেলেঙ্কারির সময়ে তাকে সামান্যতম ক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়নি। চার হাজার কোটি টাকা তার কাছে বেশি টাকা নয়, আটশ কোটি বেশি টাকা!

আতিউর রহমান পদত্যাগ না করলে, নিজে পদত্যাগের হুমকি দিলেন। বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পদত্যাগ করবেন, এমন কথা বলেননি। অর্থমন্ত্রীর যা করার ছিল, তার প্রায় কিছুই করেননি।

আর্থিকখাতের বিশৃঙ্খলার জন্যে আতিউর রহমানের চেয়ে অনেক বড়ভাবে দায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নিজে।

১০. চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনা একটি বিষয়। তার চেয়ে বড় বিষয় কীভাবে চুরি হলো, কারা জড়িত বিশেষ করে ভেতরের কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করা। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। ড. ফরাস উদ্দিনের তদন্ত কমিটির ওপর আস্থা রাখতে চাই।

ড. আতিউর রহমান চলে গেছেন। তিনিও নিশ্চয় তদন্তের বাইরে থাকবেন না। পদত্যাগ করে মহান হয়েছেন, সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, এসব গল্প এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। কেন তিনি গোপন করলেন, চাপা দিতে চাইলেন, তার অনুসন্ধান হওয়া জরুরি। আরও জরুরি রিজার্ভের পুরো বিষয়টি তদন্ত করা। যে চুরি প্রকাশিত হলো, তার বাইরে আরও চুরির ঘটনা আছে কিনা, চাপা দেওয়া হয়েছে কিনা, দেশের মানুষকে তা জানানো দরকার।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক