ধর্মের নামে এই দেশের একতা কেউ ভাঙতে পারবেন না– শহীদ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের ফেসবুক থেকে।
ঘুরে-ফিরে রাজনীতির খেলায় পুরোনো চালগুলোই ফিরে আসছে। তাই পুরোনো বোতলে নতুন মদের মতো পুরোনো কৌতুক নতুনভাবে বলে লেখাটা শুরু করা যায়। এক স্বৈরশাসক আর এক সুদখোর মহাজন বসে বসে মদ গিলছে। এমন সময়ে সেখানে দুই ছাত্র এলো। তারা খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো– দেশের অনেক কিছু গেলার পর আপনারা এখন মদ গিলছেন? লজ্জা নেই আপনাদের? আরে আপনারা তো লিভার পচে মারা যাবেন! স্বৈরশাসক অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন আর মহাজন উত্তর দিলেন– রাজনীতি আর ব্যবসায় লজ্জা থাকতে নেই। তোমাদের আগেও যারা এসব উপদেশ দিতে আসতো তারা এখন আর নেই। যেখানেই থাকি আমরা আগের মতোই আছি!
শাসকদের চরিত্র আগের মতো বা একই রকম থাকে বিধায় বলা হয় ইতিহাস কোনও না কোনোভাবে ফিরে আসে। একই সাথে রাজনীতির পুরোনো চালও ফিরে আসে যেন। উদাহরণ দেওয়া যাক কয়েকটা-
এক. রাজনীতির সবচেয়ে পুরোনো ও সর্বনিকৃষ্ট কার্ড হচ্ছে ধর্মের কার্ড। ব্রিটিশ আমলে এটি বারবার ব্যবহৃত হওয়ার কারণে শেষমেশ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও পাকিস্তান ও ভারতে যতটা এই কার্ডের প্রভাব আছে, বাংলাদেশে ঠিক তেমনটি বা ভয়াবহ হয়নি কখনও। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে ৬৪ সালের দাঙ্গার পর সর্বশেষ এই ধর্মের কার্ড খেলেছিলেন স্বৈরাচার এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পর ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার ইস্যু নিয়ে দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিয়েও এরশাদ টিকে থাকতে পারেননি।
বহু দিন পর ড. ইউনূসের আমলে এমন একটা ঘটনা ঘটলেও নিশ্চিত হওয়া গেলো না কে বা কারা এই কার্ড খেলেছে! কারণ-
ক) চিন্ময় দাসকে কথিত ইসকনের নেতা হিসেবে গ্রেফতার করা হলেও শিশু নিগ্রহের কারণে তাকে ইসকন থেকে কয়েক মাস আগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি তখন থেকেই ইসকনের কেউ নন। অথচ সবার রাগ গিয়ে জমেছে ইসকনের ওপর। বড় কোনও দাঙ্গার ঘটনা না ঘটলেও ইসকন তথা সনাতন ধর্মের মানুষের প্রতি আরোপিত ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজের একটি এই আরোপিত ঘৃণার চাষ। কারা করছে এমন? ‘হিন্দু না মুসলিম আজ জিজ্ঞাসে কোন জন’?
খ) বলা হচ্ছে চিন্ময়কে সনাতন বা ইসকনের নেতা হিসেবে গ্রেফতার করা হয়নি, জাতীয় পতাকা অবমাননার কারণে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে বিধায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ড. ইউনূস সাহেবের আমলে যিনি চিন্ময়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সেই মি. ফিরোজ বিএনপির একজন নেতা। এই মামলার কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মামলার প্রায় এক মাস পরে চিন্ময় সাহেবকে গ্রেফতার করা হলো! তাকে আদালত থেকে জেলে নেওয়ার সময় বিক্ষোভ হয় এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। এই বিক্ষোভের সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!
প্রশ্ন হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে এর আগে এমন একাধিক ঘটনা ঘটলেও এই সময়ে কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না? আনুমানিক দুই ঘণ্টা সময় ধরে চিন্ময় দাসকে বহনকারী পুলিশি ভ্যান আটকে রাখা হয়। সময় পাওয়া সত্ত্বেও কেন প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি?
কেন একজন আইনজীবীকে খুন হতে হলো? পতিত সরকারের সময় নিহত হওয়া অনেকের মৃত্যুর দায় যদি শেখ হাসিনার হয় তাহলে আইনজীবী আলিফ হত্যার দায় কার?
গ) এ দেশে অনেক কিছু ভাইরাল হয়। শেখ হাসিনার ‘আপা আপা’ কিংবা ‘চট করে চলে আসা’র টেলিফোন সংলাপ ভাইরাল হয়। ভাইরাল হয় সেনাবাহিনীর সাথে সাধারণ জনগণের অনেক ঘটনার ভিডিও। ভাইরাল হয় অনেক দোকানের চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতি করার দৃশ্য। চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী আলিফ নিহত হওয়ার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও সেটি দু-একটা টিভি ছাড়া কোথাও প্রচার হয়নি। ঘটনার কয়েক দিন পরেও কেন আসামিদের পরিচয় খোলাসা করা হয়নি?
আমরা সঠিক তদন্ত চাই, প্রকৃত অপরাধীর গ্রেফতার চাই। এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী বা পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃত আসামিদের পরিচয় জানানো হয়নি।
ঘ) আসামিদের পরিচয় জানানো হয়নি বিধায় আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের দায় অনেকেই আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে দিয়ে শান্তি পাচ্ছেন। সরকারের কেউ নির্দিষ্ট করে খুনে অংশ নেওয়া কারও পরিচয় বা মোটিভ তুলে ধরতে পারেননি। তারা ঢালাওভাবে বলছেন কখনও আনসার হয়ে, কখনও গার্মেন্টস শ্রমিক হয়ে, কখনও রিকশাচালক হয়ে আওয়ামী লীগ নাকি ফিরে আসার চেষ্টা করছে। তারা ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে।
আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে এই তত্ত্ব প্রচার করেও সফলকাম হয়নি, পালিয়ে গেছে সদলবলে।
দুই. দিন যায় ষড়যন্ত্র থাকে! ষড়যন্ত্র ছাড়া রাজনীতি যেন চলেই না। শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার যেমন মীরজাফর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পাশে যেমন খন্দকার মোশতাক, তেমন আর কোনও ষড়যন্ত্রকারী বা বিশ্বাসঘাতক খুঁজে পাওয়া যায়নি বিধায় এখন চলছে ট্যাগের যুগ। যেমন ৭২-৭৫ সাল। এসময়ে যারা বিরোধিতা করতো তাদের বলা হতো পাকিস্তান ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল! পাকিস্তানপন্থি কিংবা রাজাকার ট্যাগ তো ছিলই। ৭৫ থেকে ৮২ পর্যন্ত ছিল রুশ ভারতের দালালের ট্যাগ! এরা নাকি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব চাইতো না। জামায়াত বলতো তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পাহারাদার। এরশাদ আমলেও এই ট্যাগ পুরোদমে ছিল। খালেদা জিয়ার দুই আমল আর শেখ হাসিনার তিন পর্বের শাসনেও এই ট্যাগ বহাল তবিয়তে ছিল। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলে ছিল বিএনপি রাজাকার জঙ্গি ট্যাগ। এই ট্যাগ এই আমলেও বহাল তবিয়তে আছে। এখনকার ট্যাগ হচ্ছে ‘পতিত স্বৈরাচারের দোসর’ বা ‘হাহুতাশ লীগ’! শাসকদের যেকোনও ব্যর্থতা শেষমেশ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা ট্যাগের আড়ালে ঢাকা যায় না!
মামলা দিয়েও বিরোধীদের কণ্ঠ শেষমেশ রোধ করা যায় না।
তিন. পতিত আওয়ামী সরকারের মতো এই সরকারের মামলাবাজি ও অজ্ঞাতনামা জনিত রোগ আছে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও মামলা হামলার ব্যাপার ছিল। স্বাধীনতার পরও এই ধারা অব্যাহত ছিল, এখনও আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। এখনও যেকোনও রাজনৈতিক মামলায় এক দুইশ’ অজ্ঞাতনামা যোগ হয়, যেন বিরোধীদলীয় নেতারা হামলা মামলার জাঁতাকলে নিদারুণভাবে পিষ্ট হয়। আগে আসামিদের আদালতে নেওয়ার পথে এক দুই জনের গায়ে হাত তোলা বা রক্তাক্ত করে দেওয়ার নজির ছিল। ড. ইউনূস সরকারের সময় বিশেষ করে ২০২৪-এর আগস্ট সেপ্টেম্বরে অক্টোবরে সেটা শিল্পে পরিণত হয়। দেশ বিদেশে এর সমালোচনা হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী কঠোর হওয়া শুরু করলে এটা কমে আসতে থাকে। চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ড মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে।
চার. কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি কখনও হিংসা হতে পারে না। ভারতের প্রতি নতজানু না হয়ে স্বাভাবিক অথচ দৃঢ় সম্পর্ক গড়ায় কোন সরকার কতটা মনোযোগী ছিল? সীমান্তের তারকাঁটায় ঝুলবে ফেলানির মৃতদেহ আর আমরা তা মেনে নেবো এটা যেমন কাম্য না, ঠিক একইভাবে কোনও দেশের পতাকা অবমাননার ব্যাপারটাও কাম্য নয়। রাজনীতির নামে এমন কোনও বক্তব্য কাম্য নয়, যেটা ভারত ও বাংলাদেশের মানুষকে আরও বিভাজিত করবে, একের প্রতি অন্যের হিংসা ও বিদ্বেষ বাড়বে। সেভেন সিস্টার্স কিংবা সংখ্যালঘুদের নিয়ে এমন কোনও ঘৃণা ছড়ানো উচিত না, যাতে এ দেশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তান আমাদের স্বাধীনতার শত্রু। একই সাথে মনে রাখা উচিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ কারও আগ্রাসন মেনে নেয়নি কখনও। সুতরাং মুখে বড় বড় বুলি আওড়ালে ভারতের সাথে নতজানু কূটনীতির দিন শেষ হওয়া উচিত। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার যদি নতজানুই হয়ে থাকে, ড. ইউনূসের সরকার কতটা দৃঢ়চেতা সেটা বোঝার ক্ষমতাও মানুষের আছে।
পাঁচ. প্রায় চার মাস পরেও দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে, যানজট বেড়েছে রাস্তাঘাটে। যে যেভাবে পারছে দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় এসে নামছে। মানুষের ভোগান্তি কমছে না। সারা দেশে লেজে গোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। যে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়েছে তাদের মধ্যে মতভেদ ও বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন দেবে তার কোনও রূপরেখা নেই। ওয়ান ইলেভেনের অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। সরকারের গোপনীয়তায় কী কোনও দল গড়ে উঠছে? তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই কি সরকার নির্বাচন আয়োজনে গড়িমসি করছে? সাম্প্রদায়িক উসকানি আর চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার জের বহুদিন টানতে এসব বলেই মনে হচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ড. ইউনূসের সরকার দেশটাকে আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে?
ছয়. বলা হচ্ছে এই সরকার ‘জেনজেড এনজিও গ্রাম (চট্টগ্রাম) সরকার’। এনজিও চালানো আর দেশ চালানো এক কথা নয়। বয়স যখন চেপে বসে তখন অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না। এই সরকারের ওপর কি বয়সও চেপে বসেছে? যে ছাত্ররা রাজপথে নেমে বুক চিতিয়ে গুলি হজম করে স্বৈরাচার তাড়ায়, আহত সেসব মানুষকে কেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়ি আটকে দাবি-দাওয়া পেশ করতে হবে? যে আনসারদের ষড়যন্ত্রকারী বলছেন তাদের দাবি-দাওয়াগুলো সঠিক কিনা সেটি কি যাচাই করে দেখেছেন? প্রতিবেশী দেশের ইন্ধনের কথা বলছেন, কিন্তু বেতন না পাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিকরা কীভাবে ন্যায্য বেতন ফেরত পাবেন সেই ব্যবস্থা কী করতে পেরেছেন? দোহাই আপনাদের, ষড়যন্ত্রের তকমা না দিয়ে রাস্তায় নামা মানুষদের মনের কথাগুলো শুনুন।
এই সরকার বিপ্লবী সরকার নয়। শুরুতেই সংবিধানের পকেটে ঢুকে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার। এখন আর বিপ্লবী কথাবার্তা বলে লাভ নেই। আওয়ামী লীগ এখন অতীত, তাদের গালি দিয়ে বা নিষিদ্ধ করেও কোনও লাভ হবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল আওয়ামী লীগ। পলায়নে রেকর্ড করার পর ফিরতে তাদের একুশ না বিয়াল্লিশ বছর লাগে সেটিও দেখার ব্যাপার। আপনারা একবার বলছেন অর্থনীতির অবস্থা তেমন খারাপ না, আবার বলছেন দেশ ঝাঁঝরা হয়ে আছে। টাকা না ছাপালেও চলবে এমনই ধারণা ছিল। সেটাও বদলে ফেলা হয়েছে।
ড. ইউনূসের সরকার কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে? যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে চলে যাবার পথ সংস্কার করা শুরু করেন। না হলে আপনাদের বহুবার বলা সংস্কারে নিজেরাই ‘সংস্কারিত’ হয়ে যাবেন।
কোনও লুকিয়ে রাখা উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে আপনারা যদি ব্যর্থ হন, তার দায়ভারও আপনাদের নিতে হবে!
লেখক: রম্যলেখক