ফেসবুকে শিশু-কিশোর কী করে!

উদিসা ইসলামজনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ১৮ বছরের নিচে একাউন্ট খোলার নিয়ম নেই। তাতে কী? ১৮ বছর লিখে দিব্যি ১১ বছরের ছেলেমেয়েরা সারারাত কাটিয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকে। বাড়াচ্ছেন ‘ফ্যানস’ আর ‘ফলোয়ারস’। এমনকি শিশুর প্রতি মুহূর্ত ধরে রাখতে ‘ডিজিটালি একটিভ’ বাবা-মায়েরা দিব্যি ৬ বছরের সন্তানের নামে একটা করে একাউন্ট করে রাখছেন। অথচ আগের কথা ভাবুন, ছবি প্রিন্ট করে আমাদের সেই ৮১ সালের ছবি এখনও সংরক্ষণে আছে তো। নিজের ‘ভাল থাকা’, শিশুকে কতকিছু করতে দিতে পারা দেখানোর কি আছে! ভেবে দেখবেন আপনার শিশুকে অবাধে ছবি পোস্টের অনুমতি দিয়ে কী সাংঘাতিক জগতে ঠেলে দিচ্ছেন। তার ছবি যেকোনও জায়গায় যেকোনওভাবে অপব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছেন। যেকোনও অঘটন ঘটে গেলে বাবা মাকে কোনওদিন যদি এই শিশু যদি বলেন, তুমি আমাকে না থামিয়ে অপরাধ করেছিলে। বা তুমি ঠিক জায়গায় থামোনি, তখন তাদের কি উত্তর দেবেন ভেবে দেখেছেন একবার!
১.
সম্প্রতি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়া দুই কিশোরের মারধোরের ভিডিও দেখতে দেখতে পরিস্কার হয় কয়েকটি দিক। অক্সফোর্ড এর শিক্ষার্থী নুরুল্লাহকে ডেকে নিয়ে জুনায়েদ যখন মারধোর করে (তারা ফেসবুকে পূর্ব পরিচিত) তখন বের হয়ে আসে একের পর এক বিষয়গুলো। জুনায়েদ একজন মেয়ের নাম বারবার নিতে থাকে (ইচ্ছাকৃতভাবেই)। আর একজন বড়ভাই ‘রিজভী’র নাম। একজন নারী এবং একজন বড় ভাই। এরপর ফেসবুকে ইভেন্ট খোলা হয় জুনায়েদের বিরুদ্ধে। আশ্চর্য লাগে সেখানে জুনায়েদকে যতটা হেনস্তা করা হচ্ছে জঘন্য ভাষায়, আর যে মেয়েটির নাম জুনায়েদ উল্লেখ করেছিল তাকে নানান ছবি এবং ভয়ঙ্কর ভাষায় আক্রমণ শুরু করা হলো যিনি কিনা আদৌ সিনে নেই। একাধিক নারীর ছোট পোশাকের ছবিতে ভরে গেলো ফেসবুক পেজের দেয়াল।

আরে আরে দাঁড়ান, ভাববেন না ছোটলোকের সন্তানের ভাষা এমনই হবে। এরা আপনার আমারই সন্তান। সকালবেলা গাড়ি চড়ে সেরা স্কুলগুলোরই কোনও একটাতে ঢুলুঢুলু চোখে যায়। কেন যায়? শুনুন মাদকের কবলে পড়া এ লেভেলের রাতজাগা সিয়ামের কথা:

আমার বাবা আমাকে কোনও সম্মান করে না। বন্ধুদের সামনে মারে। আমার মাকে আমার সামনে গালি দেয়, মারে। লোকটার খালি অনেক অনেক টাকা আছে। কথায় কথায় বলে: আমার নামে তিনটা ফ্ল্যাট আছে। আবার হুমকি দেয় ঠিক মতো না চললে সেগুলো আমারে দিবে না। যখন আমার গায়ে হাত তোলে তখন মাঝে মাঝে মনে হয় মেরেই ফেলি। মা সারাক্ষণ বোঝায়। কিন্তু আপনি বলেন, আমার নামে এতো সম্পত্তি, কষ্ট করে পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করতে হবে কেন, পাস করলেইতো হয়। ফ্রাস্টেশন কাটে ফেসবুকে। আমার অনেক মাস্তান বন্ধুও আছে ফেসবুকে। এসব থাকা লাগে, ক্ষমতা।

 

 


  

 

২.

১২ বছরের সিয়ামকে জিজ্ঞেস করা হলো সারারাত ফেসবুকে কি করো? আনলিমিটেড ফান। বাসায় কিছু বলে না? জানেই না। জানে না কীভাবে? বাবা-মা রাত করে বাসায় আসে, এসে দেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু ফোনে ইউজ করি। আমার ক্লাসের কোচিং এর সব বন্ধুরাই থাকে। কী নিয়ে আলাপ করো, একটু লাজুক হাসি হেসে বলল, অনেককিছু। মেয়েদের নিয়ে ফান করি। ওরা যে আমাদের মতো শক্তিশালী না এগুলো নিয়ে ফান কার্টুন ভিডিও বানায় বড় ভাইয়েরা সেগুলো দেখি। আমাদের সিক্রেট অনেক পেজ আছে।

আজকালের নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবার শিশুদের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দেওয়া এবং ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার শিশু কিশোরদের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে এমনটা এযুগে বলা সম্ভব না। কিন্তু এর মধ্যে আপনার শিশু কোন বয়সে কোনটা করবে তার দিকনির্দেশনা দেওয়ার কোনও না কোনও জায়গাতো থাকতে হবে। আপনার ৯ বছর বয়সী মেয়ে বা ছেলে পর্নোগ্রাফি দেখলে তাকে বুঝাতে হবে এটা যৌনসম্পর্কের উদাহরণ না। এই দায়িত্বটা কতটা পালন করেন আজকালের অভিভাবকরা। আর করলেও নয়বছরের মস্তিস্ক আপনার পরিণত বয়সের ব্যাখ্যা বুঝবে কিনা সেটা একবার ভাববেন কি?

আমরা শৈশব কেড়ে নিয়েছি ওদের। শিশুরা মেশে বাবা মায়ের বন্ধুদের সাথে। তার জন্য রাখিনি তাদের নিজেদের জগত। ফেসবুকে তারা যাদের সাথে যোগাযোগ করছে তারা সমবয়সী না। এমনকি বড়দের সাথে মিশতে নিজেকে বড় বানিয়ে নিয়ে মিশছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে শিশুতোষ বলে যে সময়টা তার জীবনের জন্য জরুরি, সেটা সে হারাবে। হারিয়ে ফেলছে প্রতিনিয়ত। সব বাবা-মা একরকম তা বলছি না। কিন্তু বড় অংশ যখন সেইদিকে যান তখন সমাজে যারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসান না তারা হঠাৎই নিজেদের এলিয়েন ভাবতে থাকেন।

শেষ করি একটা গল্প দিয়ে। একদেশে এক রাজাকে তার এক চ্যালা বুদ্ধি দিলো: রাজা মশাই, আপনি মানুষ, আপনি সেরা। অন্যরাও যদি মানুষ হয় তাহলে কি করে আপনি আলাদা? রাজার মনে ধরলো কথাটা। এখন উপায়? মোসাহেব কহিলেন, সামনের বৃষ্টিতে সবাইরে বাধ্যতামূলক ভিজতে হবে, আর এই পানি গায়ে লাগলে সবাই শুয়োরে পরিণত হবে। রাজা মশায় একাই মানুষ। তেমনই হলো। এরপর চারপাশে শুয়োর ঘোরে, রাজা মশায় মানুষ। রাজা একাকিত্বে ভোগেন, কাঁদেন, মানুষ হিসেবে গর্ব বোধ করেন কিন্তু সঙ্গীতো কেউ নেই। একসময় একটা বটগাছের নিচে জমে থাকা বৃষ্টির পানি গায়ে মেখে রাজা মশায়ও শুয়োর হয়ে তার একাকিত্ব ঘোচান। রাজার মতো ‘আমার গায়ে না লাগলেই হলো’ ভাবনা বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে ভাবার এখনই সময়। সমাজ ভাঙছে।

লেখক: সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন