আবার আন্দোলন?

২০১৫ সালের শুরুতে ৩ মাসের ব্যর্থ আন্দোলনের পর বিএনপি নেতাদের মুখে আন্দোলনের হুংকার খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু ইদানীং বিএনপির কোনও কোনও নেতার মুখ থেকে আবার ‘আন্দোলন’ শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জাতীয় সম্মেলন শেষে বিএনপি আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামবে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানের কথা বিএনপি বহু বছর ধরেই বলে আসছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটবে বলে একাধিকবার দিন তারিখ ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের পতন হয়নি। বিএনপির জনবিচ্ছন্নতা বেড়েছে। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এখন একেবারেই ভেঙে পড়ার মুখে। গত পৌরসভা নির্বাচনে দলটির পরাজয় হয়েছে। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলেও বিরাট পরিবর্তন হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বরং সব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থীও দিতে পারছে না। এই অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিলে বিএনপি কতটুকু সুফল পাবে সে প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠতে পারে।
গণআন্দোলন বা অভ্যুত্থানের প্রশ্নে স্বপ্নবিলাসী হয়ে লাভ নেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, কোনও দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা বসে আন্দোলনের একটি রূপরেখা তৈরি করে দেশবাসীর সামনে পেশ করবেন আর দেশের মানুষ অমনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং সরকারের পতন ঘটে যাবে। নেতারা চাইলেও অনেক সময় আন্দোলন হয় না, আবার কখনও বা না চাইলেও হয়। জনমনস্তত্ত্ব একটি জটিল বিষয়।
রাজনীতিবিদ হলেই যে কেউ জনমনস্তত্ত্ব পুরও বুঝতে পারেন, তা নয়। এটা বুঝতে পারলে অনেকেই গান্ধী কিংবা শেখ মুজিব হতে পারতেন। কখন, কোন ঘটনায় জনমনন্তত্ত্বে কি অভিঘাত সৃষ্টি হয় এবং তার পরিণতিতে মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা আগে থেকে অনুমান করার মতো রাজনৈতিক জ্যোতিষী যদি থাকতো তাহলে শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনীতির চালচিত্র অন্যরকম হতো। আসলে রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনও ছকবাঁধা পথ নেই। কোনও রাজনীতি-অভিজ্ঞ ব্যক্তি অন্তত এটা বলতে পারবেন না যে, কোনও নির্দিষ্ট পথে হাঁটলেই সফল আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যারা কথায় কথায় বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর কিংবা নব্বইয়ের গণআন্দোরনের কথা বলেন, তারা কি আসলে কখনও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে, কীভাবে এবং কি কি কার্যকারণ সম্পর্ক যুক্ত হয়ে ওইসব ঐতিহাসিক আন্দোলনে ব্যাপক জনসম্পৃক্তি ঘটেছিল এবং আন্দোলন সফল পরিণতি অর্জন করেছিল? নেতারা নির্দেশ দিয়েছেন, তারিখ ঠিক করে দিয়েছেন আর মানুষের জীবনবাজি রেখে রাজপথে নেমে গেছে- ঘটনা কিন্তু সেরকম নয়। এ জন্য অনেককে নানা ধারায় এবং ধারাবাহিকভাবে অনেক কাজ করতে হয়েছে।
সরকার নির্যাতনের পথ বেছে নিলে, লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস চালালেই বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে গণঅভ্যুত্থান ঘটায় তাও নয়। যদি সরকারি নির্যাতন কিংবা মানুষ হত্যার ঘটনা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির বড় কিংবা একমাত্র উপাদান হতো তাহলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে একটি নয়, কয়েকটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হতো। জোট সরকার নানা সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাড়াও কখনও কখনও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও ভয়াবহ দমন-পীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে। অথচ তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অনেক চেষ্টা করেও বড় ধরনের গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মেয়াদের আগে সরকারও পদত্যাগ করেনি।

কেবল কোনও রাজনৈতিক দলের একক আহ্বানেই দেশে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয় না। যখন বিভিন্ন সামাজিক শক্তি সংগঠিতভাবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করে, তখনই কেবল রাজনৈতিক আন্দোলন জঙ্গি রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে সামাজিক শক্তি বা শ্রেণি-পেশার সংগঠনগুলোর অবস্থা কী? সবার মধ্যেই বিভাজন ও বিভক্তি। ছাত্ররা এখন আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নেই, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনেরই শক্তি বা জমায়েত ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি। শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রায় অস্তিত্বহীন। পেশাজীবী সংগঠনগুলো বিভক্ত এবং দুর্বল। অতীতের যে-সব আন্দোলনের সাফল্যগাঁথা এখন আমরা প্রায়ই উল্লেখ করে থাকি সে-সব আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবীসহ সবার মিলিট্যান্ট অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ছাত্র-শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই অতীতের সফল আন্দোলনগুলো জঙ্গি রূপ নিয়েছিল। বর্তমানে এই শক্তিগুলো যে অবক্ষয়ের শিকার- এটা মনে রেখেই গণআন্দোলনের পরিকল্পনা করতে হবে। বিবেচনাহীন ঘোষণায় অতীতের কোনও কাজ হয়নি, এখনও হবে না। বিএনপি নেতৃত্ব বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া সবকিছু বিবেচনা না করেই কেবল সরকার পতনের কথা বলে যাচ্ছেন। সরকার পতনের জন্য তার যতোটা তাড়া স্বভাবতই দেশের মানুষের ততোটা নয়।

 

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদ শাসনের অবসানের পর থেকে দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা চালু হলেও নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদকালের আগেই ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধী দলের আন্দোলন করাটাও একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। অবশ্য হরতাল, লাগাতার হরতাল, অবরোধ, লংমার্চ, মানববন্ধনসহ আন্দোলনের নানা ধরনের কর্মসূচি পালন সত্ত্বেও নির্বাচিত কোনও সরকারকেই মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব হয়নি। নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে মানুষের ব্যাপক সাড়া না পাওয়ার বড় কারণ সম্ভবত এটাই যে, ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে যারা ক্ষমতায় আসতে চায় তারা উন্নত শাসন উপহার দিতে পারবে কি-না, সে বিষয়ে মানুষের সংশয়। মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই এটা উপলব্ধি করছে, সরকার পরিবর্তন হলেই মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেসব কথা বলা হয়, ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে যাওয়ার নজির মানুষ দেখছে। সেজন্য গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পড়ার জন্য কেউ পরিবর্তন চায় না। মানুষের জীবনের সমস্যা-সংকট সমাধান করার মতো আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি সম্পন্ন নতুন রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ না দেখলে গণঅভ্যুত্থান তৈরি হতে পারে না। দেশের রাজনীতিতে যে এখন তীব্র তিক্ততা চলছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি গত কয় বছর ধরেই পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে আছে। একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই দেশ এগিয়ে চলছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না, বিশ্বাস করেন না। কেবল ভিন্ন দলের ক্ষেত্রে নয়, নিজ দলের এমন অবস্থা আছে। রাজনীতির নামে চলছে ব্লেম গেম বা দোষারোপের রাজনীতি। কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কি হবে তা সহজেই বলে দেওয়া যায়। ঘটনা বা দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের চাইতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দোষ চাপানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপি দেশের শত্রু। দেশপ্রেমের সোল এজেন্সি নিয়ে বসে আছে একমাত্র সরকারি দল। আবার বিএনপিও মনে করে, তাদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক আর কেউ নেই। সরকারি দল দেশটাকে ‘বিক্রি’ করা অথবা ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত আছে।

রাজনীতির এই তিক্ত পরিবেশের জন্য কেউ কেউ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে সমানভাবে দায়ী করে থাকেন। এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য করলে অনেকেই খুশি হন। সংবাদপত্রে যারা কলাম লেখেন, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যারা কিছুটা ভূমিকা পালন করেন, তাদের অনেককেও দেখা যায়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে তুলোধুনা করতে। কিছু মানুষ হয়তো এতে তাদের বাহবা দেন, তারিফ করেন। কিন্তু আসলে কি এটা ঠিক? নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে এই দুই দলের ব্যবধান কমে আসলেও একেবারে একবিন্দুতে গিয়ে মেশেনি। তাছাড়া দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির রেকর্ড কি সত্যি এক রকম? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রাজনীতির মধ্যে কি একেবারেই কোনও পার্থক্য নেই?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে শুরু করে অনেক ইস্যুতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান স্পষ্টতই ভিন্ন ও বিপরীত। স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, দলবাজি, ব্যর্থতা-অযোগ্যতা দুই দলেরই আছে। তারপরও দুই দলকে এক পাল্লায় মেপে সমান দোষে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে কি?

কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি তার রাজনীতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে কি পরিবর্তন আনে সেদিকেই এখন রাজনীতি আগ্রহী সকলেরই মনোযোগ। বিএনপি যদি আবারও আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও সহিংসতার পথেই চলতে চায় তাহলে বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি না হয়ে হতাশাই বাড়তে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

bibhu54@yahoo.com