নারী দিবসের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এটা কী বললেন!

চিররঞ্জন সরকারআন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি পশ্চৎপদ সমাজের একজন নারী প্রধানমন্ত্রী যখন নারীদের নিয়ে কথা বলেন, তখন তা আলাদা গুরুত্ব পায়। আন্তর্জাতিক নারীদিবসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে নারীমুক্তি ও লিঙ্গসাম্য-বিষয়ক সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার কথা বলেছেন। এই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়েছেন, জনসংখ্যার এক বৃহদাংশকে বঞ্চিত রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। বলেছেন, নারী কর্তৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইসলাম স্বীকৃত। তিনি ধর্মকে নারীপুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও বলেছেন। নারীর জন্য আরও সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দেশের প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থায়, শিক্ষা থেকে প্রতিরক্ষায় মেয়েদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘মেয়েদের হাতে কাজ দিলে তারা তা অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে করেন’ কারণ, ‘মেয়েরা সব পারেন। কথায় আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’ এখানে এসেই প্রধানমন্ত্রী গোল বাধালেন!
‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’-এই বাক্যটি মোটেও নারীর পক্ষে যায় না। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে নারী নির্মাণ। আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণা অনুযায়ী নারীর একটি বিশেষ পরিচয় ‘গৃহিণী’। প্রত্যেক বিবাহিত নারী, যদি সে চাকরিজীবী (বা কর্মজীবী) না হয়, তাহলে তার একমাত্র পরিচয়, গৃহিণী, ইংরেজিতে যাদের ‘হাউসওয়াইফ’ বলা হয়। তার অন্য কাজ থাকলেও তাকে গৃহের কাজ কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে এবং কাজ থেকে ফিরে এসে করতে হয়। শুধু ঘরের রান্নাবান্না করা নয়, সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের কাজ থেকে সবকিছু তাকে করতে হয়। নারী যখন বেশি সংখ্যায় ঘরের বাইরের কাজে এলো, তখন থেকেই দাবি উঠেছে মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশুদের দিবা-যত্ন কেন্দ্রের। পুরুষ নিজেও সংসার করে, সে বিবাহিত, তারও সন্তান আছে, কিন্তু কোনও কর্মজীবী পুরুষের ক্ষেত্রে এ দাবি কখনও ওঠেনি। কারণ তাকে সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব সেভাবে নিতে হয় না। শুধু টাকাটা দিলেই হয়। স্ত্রী ও মা হিসেবে এ কাজ নারী নিজেই করে। নারী কাজে নেমে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন এসেছে, তেমনি তাকে অনেক অর্থনৈতিক দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে। আগে পারিবারিক কাজে পুরুষের নির্দিষ্ট ভূমিকা, যেমন বাজার করা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নেওয়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দেওয়া ইত্যাদি ছিল। এখন এসব কাজ বেশিরভাগ নারীকেই করতে হয়।
‘যে রাধে সে চুলও বাধে’-এই আপ্তবাক্যটি আউড়ে নারীর ওপর দুইগুণ তিনগুণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। নারীকে তা মানতে মোটিভেশনও দেওয়া হয়। এ যেন অর্থনৈতিক স্বাধীকারের শাস্তি! এতে নারীর ওপর বাড়তি বা ডাবল কাজের বোঝা এসে পড়ে। নারীবাদী ভাষায় ডাবল বার্ডেন। নারীর গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়নের দাবি উঠেছে এবং ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারী দিনে কমপক্ষে ১৬ ঘণ্টা সময় ঘরের কাজে ব্যয় করে, জাতীয় অর্থনীতিতে যার কোনও আর্থিক মূল্য ধরা হয় না। বাংলাদেশ শ্রমশক্তির জরিপে দেখানো হয়েছে, ১ কোটি ৭২ লাখ নারী অর্থনৈতিক কাজে জড়িত আর ১ কোটি ৬২ লাখ কর্মজীবী নারী রয়েছে। কিন্তু বাকি ৩ কোটি ৫০ লাখ নারী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর এবং যারা সংসারের কাজে জড়িত, তাদের কোনও উল্লেখ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, তারা ঘরের কাজে যে শ্রম দিচ্ছে তার কোনও আর্থিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। অন্যদিকে শ্রমজীবী নারী হিসেবে যারা গার্হস্থ্য  শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, তাদের অবদানও ধরা হয় না, কারণ তারা ‘ঘরের কাজ’ করছেন। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যখন ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’- এই আপ্তবাক্যটি বলেন তখন নারীর ওপর অগোচরেই বাড়তি দায়িত্বের বোঝা বহনের দায়টি চাপিয়ে দেন।
জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর কাজের মূল্যায়ন হোক বা না হোক, সেটা সরকারকেই হিসাব কষতে হবে। অর্থনৈতিক ভূমিকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক প্রভাব আছে। নারীর হাতে অর্থ এসেছে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করার সামাজিক স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। নারী এখনও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই একপর্যায়ে এসে তাকে থেমে যেতে হয়। নারী ব্যবসা করতে পারে, ব্যবসার জন্য ঋণ নেওয়ারও পথ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যখনই সম্পদ বন্ধক রাখতে হয়, তখন সম্পত্তিতে তার অধিকার কতখানি আছে, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই তাকে এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার আওতায় স্বল্প সুদের ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। বৃহৎ শিল্পের জন্য আবেদন করতে গেলে তাকে সেই সম্পদ দেখাতে হবে, যা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার নিয়ম আছে। কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার মতো আস্থা এখনও ব্যাংকগুলো পায়নি। কারণ নারীর কোনও সম্পদ নেই, যা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলা যায়। কাজেই উদ্যোক্তা হিসেবে নারী লাখোপতি হতে পারবে, কোটিপতি হতে পারবে না। এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দিকনির্দশনা থাকা উচিত ছিল। থাকা উচিত ছিল পুরুষতন্ত্রকে পুরোপুরি মোকাবেলা করার কৌশল। কারণ নারী এখন পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রের যৌথ শিকার।

 

 

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘মেয়েরা যে দুর্নীতিতে কম জড়ান তা মেনে নেওয়াই ভালো। মেয়েদের চেয়ে দুর্নীতিতে ছেলেরা অনেক বেশি জড়ায়।’ প্রধানমন্ত্রীর এই ভাবনা ও পরিকল্পনা অভিনন্দনযোগ্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু লক্ষণীয়, শেখ হাসিনা তাঁর নারীমুক্তির সামগ্রিক ভাষ্যটি খাড়া করেছেন পুরুষতান্ত্রিকতারই ভাষায়। সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইসলামের দোহাই দিতে হয়েছে তাঁকে। ফুটে উঠেছে ‘ফেমিনাইন’ বা নারীসুলভ মনোভাব। নারীরা নারী হওয়ার কারণেই যত্নশীল, নিপুণ। তাই তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করেন, যেমনটা করেন গৃহে, তেমন ভাবেই কর্মক্ষেত্রে। ‘ফেমিনাইন’কে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি এটিকে রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহারের কথা বলেছেন। এত দিন এই ‘নারীসুলভ গুণগুলো’ রাষ্ট্রেরই ক্ষুদ্রতম একক ‘পরিবার’-এর কল্যাণে লাগছিল, এ বার বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে তার ডাক এলো, যদিও ক্ষুদ্র ঘেরাটোপ থেকেও মুক্তি মিলল না! ‘নারীসুলভ’ মনোভাবের কারণে একটি মহৎ বক্তব্য শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত মর্যাদা হারালো!

দুর্নীতির প্রসঙ্গেও হাসিনার বক্তব্য একরৈখিক, যদিও আপাত ভাবে পরিসংখ্যান তার বক্তব্যের স্বপক্ষেই যুক্তি দেবে। দুর্নীতিপরায়ণতা বা অপরাধ প্রবণতার খতিয়ানে পুরুষ নারীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে। কিন্তু এই প্রবণতা পুরুষের ক্ষেত্রে ও এই প্রবণতার অভাব নারীর ক্ষেত্রে কতটা স্বতস্ফূর্ত তা তর্কসাপেক্ষ। জেন্ডারচর্চা আমাদের বলে ‘পুরুষসুলভ’ আর ‘নারীসুলভ’ আচরণের তালিম আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আ-শৈশব আ-কৈশোর এমন ভাবে চলে যে মেয়েরা ‘ভালো মেয়ে’ হতে ভারি তৎপর থাকে। আর ভালোত্বের অন্যতম মাপকাঠি গৃহমুখিতা, ক্যারিয়ার-উদাসীনতা। ফলে দুর্নীতি আর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও যে মেয়েদের কম ঘটে, আর প্রয়োজনও পড়ে কম, তা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন গবেষণায় জেন্ডার ও ক্রাইমের সম্পর্ক খতিয়ে তাই দেখা গেছে, নারী অপরাধীরা সংখ্যায় সত্যি কম, একমাত্র প্রস্টিটিউশনেই (যা পৃথিবীর অনেক দেশেই অপরাধ) তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খানিক বেশি। কিন্তু এ সমীকরণ স্বভাবজাত বা জিনগত নয়, তাই তার ব্যতিক্রমও থাকবে, আছে, এবং ভারি মারাত্মক সে সব ব্যতিক্রম। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধাপে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদটি দখলে রেখেছেন। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই রাজনীতির ঘুঁটি সাজিয়েছেন একে অন্যের দুর্নীতিকে ইস্যু করে। আবার ২০০৭-’০৮-এর সেনা নিয়ন্ত্রিত শাসনকালে উভয়েই কিন্তু ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন দুর্নীতিরই অভিযোগে। ‘লৌহ মানবী’ হিসেবে খ্যাত সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন অর্থ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, অভিযোগ আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধেও ছিল একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ— সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন। আবার ২০১০ সালে ভারতীয় কূটনীতিক মাধুরি গুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলোও আমলে নেওয়া যেতে পারে। ৫৩ বছরের মাধুরি ভারতীয় ফরেন সার্ভিসেস-এর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামাবাদ হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ ছিল প্রতিরক্ষার গোপন তথ্যাবলী বেচে দেওয়ার।

উল্লিখিত সব ক’টি ক্ষেত্রেই নারীদের অপরাধ-প্রবণতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি বা সম্পদের লালসা কাজ করেছে, ঠিক যেমন করে পুরুষ-অপরাধীর ক্ষেত্রে। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, বলা বাহুল্য, দু’জনের ক্ষেত্রে ভিন্ন। পুরুষটি শুধু অপরাধী, নারীটি ‘মেয়ে হয়েও’ অপরাধী। মেয়েটি দু’টি মাপকাঠিতে ব্যর্থ। সামাজিক নীতির মাপকাঠিতে আর নারীত্বের মাপকাঠিতেও।

 

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে এটা মেনে নিতে বলেছেন যে, মেয়েরা দুর্নীতিতে কমই জড়ান। সাদামাটা চোখে হয়তো কথাটা ঠিকই বলেছেন তিনি। হয়তো শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণে, একটা ছেলে বা মেয়ে আদৌ অপরাধপ্রবণ হবে কি না তা আগে থেকে বলা যায় না। এর পেছনের কারণটাও উপেক্ষণীয় নয়। আসলে মেয়েদের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। সহনশীলতাও। সেটা বোঝা যায় কীভাবে? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হতে পারে। বিয়ের পর সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া একটা পরিবেশে বেশির ভাগ মেয়েই দিব্যি মানিয়ে নেয়। ওই দুটো গুণ না থাকলে সেটা সম্ভব হতো কি? আবার ধরা যাক, রাস্তা পেরোনোর সময় সামনে এক জন দৃষ্টিহীন নজরে এলো। তিনিও রাস্তা পেরোবেন। কারও সাহায্য চাইছেন। ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন, মেয়েরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলেরা বাড়ায় না, তেমন নয়। তবে মেয়েরা বেশ কয়েক গুণ যে এগিয়ে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

মেয়েরা চিরকালই অনেক বেশি যত্নশীল। এক বার ছেলেবেলায় ফিরে গেলে ভালো ভাবে বোঝা যাবে বিষয়টা। আমাদের মেয়েবেলার শুরুটাই হয় পুতুলখেলা দিয়ে। খেলার ছলে পুতুলদের খাওয়ানো, তাদের যত্নআত্তি, এমনকী, বিয়েও পর্যন্ত দেওয়া হয়। আর এর ভেতর দিয়েই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মধ্যে মায়া-মমতা বাড়তে থাকে। বড়বেলাতেও সেই মমতা মায়া থেকে বেরোতে পারে না হয়তো তারা।

তবে সব কিছুর পরেও বলব, একটা ছেলে বা মেয়ে অপরাধপ্রবণ হবে কি হবে না তার বেশির ভাগটাই নির্ভর করে তার বেড়ে ওঠার ওপর। তার পারিবারিক অবস্থানের ওপর। কীভাবে শিশু অবস্থা থেকে তাকে গড়ে তোলা হয়েছে সেটার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন, ছোটবেলায় কোনও ভুল করলে বাবা-মা যদি তাকে বুঝিয়ে বলে তবে অনেকাংশেই সেই ভুল শুধরে নেওয়ার আশা তাকে। কিন্তু, সে বিষয়টা নিয়ে যদি অত্যাধিক বকাবকি করা হয় তবে ছেলেমেয়ে বিগড়েও যেতে পারে। সে আশঙ্কা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেক বেশি জেদি হয়ে উঠতে পারে তারা। আর তা থেকেই অপরাধপ্রবণতার জন্ম নিতে পারে। এক বাক্যে দাগিয়ে দেওয়াটা ঠিক না হলেও, এটাই সত্যি, মেয়েরা অপরাধের সঙ্গে কম জড়িয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক নারীদিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো যেভাবে বলেছেন, তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। অন্য কারও মুখ থেকে যদি কথাগুলো বের হতো তাহলে হয়তো এত আলোচনার কিছু থাকতো না। প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে কথাগুলো বলেছেন নারীদের অধিকার আদায়ের দিবসে। যে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, প্রতি পদক্ষেপে নারীকে অবমূল্যায়ন করার, নারীকে দুর্বল-অযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার, নারীর খুঁত ধরার জন্য মুখিয়ে আছে, তেমন সমাজে একজন নারী প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন বক্তব্য নারীর অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারাপুষ্ট কোনও বক্তব্য কাম্য নয়। আরেকটি কথা, রাষ্ট্রের যত শিগগির অপরাধ ও লিঙ্গের সংযোগের এই থিয়োরি থেকে উত্তরণ ঘটে, ততই মঙ্গল। মঙ্গল নারীরও, আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনেরও। অবশ্য প্রতি দেশের নারীমুক্তির ভোরবেলাতেই এই সব দোলাচল থাকে, থাকে রেটোরিকের অসঙ্গতি। সে সবের উর্ধ্বে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াস ও পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাতেই হয়। বেগম রোকেয়ার দেশে লিঙ্গসাম্যের প্রথম ও উল্লেখযোগ্য ধাপ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি সচেতন, দৃঢ় ও কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট