৬৯’ থেকে ২৪’: ‘প্রান্তজনে’র প্রত্যাশা প্রতিবারই বেহাত হয়ে গেছে

সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন একজন বহুমাত্রিক লেখক। জ্ঞানচর্চা ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কার প্রচেষ্টাকে জারি রেখেছিলেন তিনি। এখানেই তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে যে রাষ্ট্র সংস্কার সবার কাঙ্ক্ষিত বিষয় হয়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্র যেমন গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হবে, হয়েও ছিল; তেমনি সমাজও হয়ে যাবে অস্থিতিশীল ও অসহনীয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ গভীরভাবে গণতন্ত্র-উজ্জীবনী এবং জনবান্ধব সংস্কারে বিশ্বাস করতেন। আবুল মকসুদের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল কৃষক-শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি। বাংলাদেশের যেখানেই আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তজনের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেখানেই ছুটে গেছেন আবুল মকসুদ, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, প্রতিকার করার চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব।  

৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সৈয়দ আবুল মকসুদ কাছ থেকে দেখেছেন। এ দুটি গণঅভ্যুত্থানের শক্তি, সমাজ পরিবর্তনে এদের ভূমিকা, অভ্যুত্থানের ফসল জনগণের গোলায় পুরোটা তুলতে না পারা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তার লেখা দেখতে পাই। এ অভ্যুত্থানগুলোতে সৃষ্টি হওয়া ব্যাপক সম্ভাবনা এবং তার সফলতা-ব্যর্থতা আমরা বুঝতে পারি আবুল মকসুদের লেখা পড়ে।

৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে বেগবান করলেও শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, শেষ অব্দি সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। আবার ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত্তি দিলেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে কাম্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কৃষক-শ্রমিকের স্বতন্ত্র আন্দোলনও ৯০’ পরবর্তী সময়ে একদিকে দুর্বল হয়েছে, অন্যদিকে বড় দুটি দলের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে।

২০২৪-এর অভ্যুত্থানে আলাদাভাবে শ্রমিক দেখা যায়নি, ছাত্র-জনতার সঙ্গে অনেক শ্রমিক ছিলেন নিশ্চয়ই। কর্মচারী দেখা যায়নি, কৃষক তো একদম না। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ন্যায্য বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়েছে ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। শ্রমিক-কৃষক, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার লেন্স দিয়ে ৬৯, ৯০ ও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে যদি আমরা ব্যবচ্ছেদ করি তাহলে চিত্রটি খুব সন্তোষজনক হবে না। এখানেই আবুল মকসুদ পাঠ প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদের ভাবনার কেন্দ্র পরিবেষ্টন করেছিল মেহনতি মানুষ ও প্রান্তজন।

৬৯-এ তাওয়া শুধু গরমই ছিল না, ছিল লু হাওয়ার মতো উত্তপ্ত। দরকার ছিল দেয়াশলাইয়ের একটু আগুন। কিংবদন্তির নেতা মাওলানা ভাসানী দেশলাই নয়, জ্বলন্ত মশালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

শেখ মুজিব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে বন্দি। আইয়ুব খানের উন্নয়নের এক দশক চলছে। মানুষজন ক্ষুব্ধ, হতাশ ও উদভ্রান্ত। তবে অনেকেই বুঝতে পারেননি যে এত মর্মান্তিকভাবে আইয়ুব খানের পতন হবে। ২০২৪ সালেও পরিস্থিতি ছিল ভালো রকমের হতাশাব্যঞ্জক।

প্রায় ৪০ দিন ধরে ঊনচল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিবাদ করছিলেন তাদের বিদ্যমান পেনশন সুবিধা বহাল রাখার দাবিতে। কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনও চলছিল সমান্তরালে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি ধীরে ধীরে সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। ১৫ জুলাইয়ের পরে নির্বিচারে ছাত্র ও জনতা হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন এমন একপর্যায়ে চলে যায় যে এতে পতন ঘটে প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী এক সরকারের।

জুলাই মাসের প্রথম দিকে যখন শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন কেউ চিন্তাই করতে পারেননি যে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে কী হতে চলেছে। এদিক থেকে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা হতে পারে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের। কিন্তু ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফসল।

যাহোক, ৫ দশকে তিন তিনটি গণঅভ্যুত্থান যেকোনও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ ও দাবি আদায়ের লেন্স দিয়ে দেখলে সবচেয়ে বেশি সফল ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ৯০-এর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ভালোভাবেই ছিল। কিন্তু দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তারা খুব সফল হতে পারেননি। আর ২৪-এর আন্দোলনে শ্রমিকরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে থাকলেও তাদের স্বীকৃতি যেমন জোটেনি, তেমনি অভ্যুত্থানের পরে তারা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।  

৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গ্রাম ও শহরে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, অভ্যুত্থানের পরে বড় রাজনৈতিক দলগুলো সেটি প্রশমিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেননা, তারা দ্রুত নির্বাচন করে ক্ষমতার দিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছিলেন। আর ইয়াহিয়া খানও মার্শাল ল’ জারি করে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে নির্বাচনমুখী করে দেন। এতে করে শ্রমিক ও কৃষকদের চলমান আন্দোলন ও তাদের ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। ১৯৬৯-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দল আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। ওই ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে টঙ্গীতে শ্রমিকরা ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন শুরু করেন, যেটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল আদমজী, ডেমরা, পোস্তগোলাসহ অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলে।

গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এবার তারা নিজস্ব শ্রেণি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়ান এবং মিল মালিকদের ঘেরাও করে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।                

শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ৭২ টাকা থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করে ১২৭ টাকা। বছরে একটি বোনাসের পরিবর্তে দুটি বোনাস। বাঙালি-অবাঙালি মালিকরা শ্রমিকদের দাবি নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেও শেষ অব্দি ইয়াহিয়া সরকারকে অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সব চুক্তি মেনে নিতে হলো। মন্ত্রী নরূ খানের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে ন্যূনতম মজুরি ১২৫ টাকা ঘোষণা করা হলো এবং নতুন শ্রম আইন  Industrial Relations Ordinance ১৯৬৯ জারি করা হলো।

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ ও বিভিন্ন চীনাপন্থি গ্রুপ কিংবা মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ সবাই এই বিরাট বিপ্লবী সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। সেদিনকার শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা হায়দার আকবর খান রনোর কণ্ঠে তাই আমরা শুনি আক্ষেপের বাণী: “শুধু পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকেই নয়, দেশীয় শোষকদের হাত থেকেও দেশকে মুক্ত করে প্রকৃত অর্থে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতিদের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার বাস্তব ক্ষেত্র সেদিন তৈরি হয়েছিল। ছিল বিপ্লবী পরিস্থিতি। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল।”[শতাব্দী পেরিয়ে , পৃ. ১৮৮-২০৩]।

এভাবেই ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট শ্রমিক-কৃষকের ন্যায্য দাবি আদায়ের অপার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায় একদিকে বামপন্থিদের ব্যর্থতায়, অন্যদিকে প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে।

একইভাবে এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সৈয়দ আবলু মকসুদ সম্পাদিত গণআন্দোলন (১৯৮২-৯০) বইয়ে বিস্তারিতভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে শ্রমিকদের  বিশেষ করে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়।

১৯৮৩ সাল থেকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা উৎখাতের লড়াইয়েও শামিল থেকেছেন। তা সত্ত্বেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থায়ী সরকারের কাছে শ্রমিক-কর্মচারীরা লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।

৬৯ ও ৯০-এর মতো শ্রমিকদের আলাদা শক্তিশালী আন্দোলন দেখা না গেলেও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিকরা ছিলেন, কিন্তু তারা ন্যূনতম স্বীকৃতিও পাননি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০২৪ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বলেন,  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন, দালিলিক বা ডকুমেন্টেশনের জায়গাগুলোতে তাদের পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য এই শ্রমিকদের কোনও স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি। উপরন্তু, চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে শ্রমিক যখন বকেয়া বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানালো, তখন সরকারি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারালেন কয়েকজন শ্রমিক।  

সৈয়দ আবুল মকসুদ দেশের প্রথম দুটি গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসবিদ। মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তাঁর বইয়ে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভের  বাইরে তিনি কৃষক-শ্রমিকের অবদানকে বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন নিয়ে লেখা বইতেও তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পাশাপাশি শ্রমিক-কর্মচারীদের অবদানকে তুলে ধরেছেন। ২৪-এর অভ্যুত্থানের সময়ে বেঁচে থাকলেও আবুল মকসুদ ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে প্রান্তিক মানুষের অবদানকে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করতেন।

এতে তাৎক্ষণিকভাবে মেহনতি জনতার হয়তো কোনও লাভ হতো না, বা শ্রমিক-বৈরী শিল্প ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটতো না; তবে ভবিষ্যতে শ্রমিক ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে প্রবল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতো।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


[*ঋণ স্বীকার – সামসুদ্দোজা সাজেন, সাংবাদিক ও গবেষক]