দিল্লির ভিসা অফিসের বেখেয়ালী আর অপেশাদারী সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের দুজন শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রীর স্ত্রীদের ভিসা হয়নি, কমপক্ষে ৫ জন সচিবের ইংল্যান্ডে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, স্বনামধন্য গায়িকা ও সংসদ সদস্য মমতাজের ভিসার আবেদনও দিল্লিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি!
দিল্লি থেকে ঢাকায় ব্রিটিশ ভিসা অফিস ফিরিয়ে আনার জন্য ব্রিটেনের যে সকল সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের ক্যাম্পেইন চলছে তার মধ্যে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী, ভয়েজ ফর জাস্টিসের চেয়ার কে এম আবু তাহের চৌধুরী, কারি লাইফ ম্যাগাজিনের সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা , গ্রেটার সিলেট ওয়েলফেয়ার এ- ডেভেলাপমেন্ট কাউন্সিল সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ক্যম্পেইন অব্যাহত রেখেছে। ব্রিটেনের সবকটি বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র ধারাবাহিকভাবে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। কোনও কিছুতেই ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে নমনীয় ভাব দেখা যাচ্ছে না। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের জালালাবাদ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে একটি অনলাইন পিটিশনে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার ব্রিটিশ বাংলাদেশির সাক্ষরের জবাবে ব্রিটিশ সরকার বলেছে, দিল্লি থেকে বাংলাদেশি আবেদনকারীদের সিদ্ধান্তের ব্যপারে ব্রিটিশ সরকারের নীতির কোন পরিবর্তন হবে না।
ব্রিটেনের কাছে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ ব্রিটেন সফর থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। মোদির সফরকালে ব্রিটেন ও ভারত ৯ বিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেছে এর মধ্যে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও পরিবেশ খাতে এই বিনিয়োগ করবে উভয় দেশ। তবে বাংলাদেশের ভিসা অফিস দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে আসলে ২০১৩ সালে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দিল্লি ঘুরে আসার পর। বাংলাদেশকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিল্লিতেই ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বলেই বলছে একাধিক সূত্র, কিন্তু বাংলাদেশ জানতে পেরেছে প্রায় এক বছর পর ২০১৪ সালে! দিল্লিকে খুশি রাখতে বা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দিতে ব্রিটেন বাংলাদেশের উপর এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা এ বিষয়টিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান করা উচিত।
ব্রিটেনের বিভিন্ন সংগঠন ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় ৫০১টি কেইস স্টাডির তথ্যের কথা আমরা জেনেছি। বাংলাদেশ থেকে আবেদন করে গত এক বছরে এই আবেদনকারীরা দিল্লির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। দিল্লি যে ভুল সিদ্ধান্ত দিচ্ছে এ বিষয়টি খোদ ব্রিটিশ সরকারের ভিসা অ্যান্ড ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, গত ডিসেম্বরের ২ তারিখে ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ তাজ শাহকে ইমেইল করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা এক ইমেইল বার্তার জবাবে, ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিয়েছে যে, দিল্লির ভিসা কার্যক্রমের মান ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে ইউকে ভিসা এ- ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও লোকবল বাড়াবে। আমাদের একটা বিষয় খেয়াল করতে হবে, একদিকে ঢাকাকে ব্রিটিশ সরকার বলছে খরচ কমাতে তারা দিল্লিতে ভিসা অফিস স্থানান্তর করছে, অন্যদিকে ব্রিটিশ আইনজীবীদের বলা হচ্ছে তাদের মক্কেলের সাময়িক অসুবিধার জন্য তারা দুঃখিত ও ভবিষ্যতে দিল্লির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও লোকবল বাড়িয়ে ভিসা প্রক্রিয়ায় গতি আনা হবে! খরচ কমাতেই যদি ঢাকার অফিস দিল্লিতে স্থানান্তর হয়, তাহলে দিল্লির স্টাফ বাড়াতে ব্রিটিশ সরকার অর্থ দেবে কোথা থেকে? প্রশিক্ষণের জন্য বাড়তি বরাদ্দ আসবে কোথা থেকে ? ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠিন ও যৌক্তিক প্রশ্নগুলো ফরেন এ- কমনওয়েলথ অফিসকে করতে হবে। এখানে নমনীয় হলেই বাংলাদেশিদের ভিসা ফি দিয়ে দিল্লির কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নেবেন, কর্মসংস্থান হবে ভারতে! বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দিল্লিতে ভিসা অফিস স্থানান্তরের পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ভিসা প্রাপ্তির সংখ্যা নেমে এসেছে ১৭ শতাংশে! ২০১৩ সালে ব্রিটিশ ভিসার সিদ্ধান্ত যখন ঢাকায় হতো, তখন ৩০ হাজার ৪১৮ জন আবেদনকারীর মধ্যে ২৩ হাজার ১৮৭ জনকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে ভিসা দেওয়া হয়েছিলো, যা মোট আবেদনকারীর ৭১ শতাংশ। ২০১৪ সালে ৩২ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে ২১ হাজার আবেদনকারী ভিসা পেয়েছিলেন, যা মোট আবেদনকারীর ৬৭ শতাংশ। তাহলে প্রশ্ন হলো ২০১৫ সালে বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে ভিসার প্রাপ্তির হার কেন ৭০ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে নেমে আসলো, সেই কৈফিয়ত কি ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস বা ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছে ঢাকা চেয়েছে? ঢাকার নিরবতা দীর্ঘমেয়াদে দিল্লিকে শুধু শক্তিশালীই করবে না, বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্পর্শকাতর তথ্য ও ব্যাংকের হিসাব দিল্লির হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। দিল্লি হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক কেন্দ্র।
ব্রিটিশ হাইকমিশন যতই ডাটা রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলুক দেশটি যেহেতু প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই ভিসা আবেদনের সিদ্ধান্ত ঢাকার হাতে রাখতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। পাকিস্তানের ভিসার সিদ্ধান্ত কিন্তু দিল্লিতে হচ্ছে না, তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে আরব আমিরাতে। কিন্তু ঢাকা যদি এখনই শক্তিশালী কুটনৈতিক উদ্যোগ না নেয় তাহলে আজ ভিসা অফিস দিল্লি গেছে, কাল ব্রিটিশ হাইকমিশনও দিল্লিতে যাবে, পরশু কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের দেশগুলোও ব্রিটিশ সরকারের দেখানো পথ ধরে একই বায়না ধরবে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে একধরণের চাপা ক্ষোভ আছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন তিনজন এমপি রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, তারা কেউই বাংলাদেশিদের অসুবিধার বিষয়গুলো নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কিছু বলেন না। যেমন বিমানবন্দরে কার্গো পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়া, ব্রিটেনের মূলধারার শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলা ভাষা তুলে দেওয়া , দিল্লি থেকে ভিসা অফিস ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যপারে তিন বাঙালি এমপি কেউই কোনও কথা বলছেন না! ভিসা অফিস স্থানান্তরের ব্যপারে পার্লামেন্টে বাঙালিদের হয়ে কথা বলেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেবার দলীয় এমপি কিথ ভাজ! কিন্তু বাঙালি এমপিরা নিরব কেন? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই! কিন্তু ব্রিটেনের কনজারভেটিভ দলের রাজনীতিবিদদের পেটের খবর হলো, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি চাইছে দিল্লি থেকে ঢাকায় যদি ভিসা অফিস ফিরিয়ে নিতেই হয় তাহলে সেটি হবে কনজারভেটিভ সরকারের সাফল্য। কোনও লেবার এমপির ক্যাম্পেইনে বা কিথ ভাজের জোরালো বক্তব্যে কনজারভেটিভ সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এই ক্যম্পেইনের ফসল লেবারের হাতে তুলে দিতে চাইবেনা। তাই ক্যম্পেইনারদেরও একটু কৌশলেই এগোতে হবে। পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের কূটনৈতিক ধাক্কার আগেই, অন্য কোনও দেশ যুক্তরাজ্যের মতো ভিসা অফিস ঢাকা থেকে স্থানান্তরের কঠিন সিদ্ধান্তের আগেই, ব্রিটিশ সরকারের সাথে জরুরি বৈঠক করে বাংলাদেশি ভিসা প্রার্থীদের দূর্দশার তথ্য উপাত্তগুলো তুলে ধরা। তথ্য উপাত্তের জন্য যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনের মাধ্যমে প্রবাসের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও আইনজীবীদের কাছ থেকে কেইস স্টাডি সংগ্রহ করে কনসারভেটিভ কোনও এমপি কিংবা মন্ত্রীর মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যথায় দিল্লিই হয়ে থাকবে ঢাকার ভিসা আবেদনকারীদের ভাগ্য বিধাতা!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি ও বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি