গ্রামের ওষুধের দোকান: জনস্বাস্থ্যে তাদের ভূমিকা

উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী গ্রাম তেলকুপি। নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি বিয়ের দাওয়াতে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও সামাজিকতার জন্য এখানে থাকতে হবে কয়েক দিন। আজকাল রাত ১০টাতেও গমগম করে পাড়ার চায়ের দোকানগুলো। চা পানের উসিলায় বের হয়েছি রাতের গ্রামের সৌন্দর্য অনুভব করবো বলে। আধাপাকা রাস্তার ধারে বিদ্যুতের খুঁটি থাকলেও ঘড়ির কাঁটার রাত ১০টা মধ্যরাত এখানে। আম গাছের ছায়ায় ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে গ্রামটি। হঠাৎ দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তির দ্রুত পদক্ষেপ। আর শোনা যাচ্ছে অসহায় নারীর কান্না। একটু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, তার নাম রফিক। তাদের ছোট মেয়েটির গায়ে আগুন জ্বর, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিকটতম উপজেলা হাসপাতাল ২০ কিলোমিটার দূর। রাস্তা অন্ধকার। কোনও যানবাহন নেই। এই মুহূর্তে ওই গ্রামের ছোট্ট একটি ওষুধের দোকানই তাদের শেষ ভরসা।

এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রামে প্রতিদিন এমন লাখো মানুষ মুখোমুখি হয় একই সংকটে। সরকারি স্বাস্থ্য কাঠামো যখন বহুদূর, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই ওষুধের দোকানগুলোই হয়ে ওঠে প্রাণরক্ষাকারী। দোকানদার হয়তো পেশাদার ডাক্তার নন, কিন্তু জ্বর-টাইফয়েড-নিউমোনিয়ার লক্ষণ চেনেন গ্রামের মাটির গন্ধ মাখা অভিজ্ঞতায়। আর এই গল্প শুধু রফিকের নয়, এটি আমাদের সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আয়না।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন কোনও শিশু রাতে জ্বরে কাঁপে, কোনও বৃদ্ধ হঠাৎ শ্বাসকষ্টে ভোগেন কিংবা কৃষক আহত হন, তখন সবচেয়ে দ্রুত যে সহায়তা পাওয়া যায়, তা হলো গ্রামের বাড়ির পাশের ‘ওষুধের দোকান’। গ্রামে হাসপাতাল বা ডাক্তারের সংখ্যা কম থাকে। তাই মানুষ অসুখ হলে প্রথমেই ওষুধের দোকানে যায়। এই দোকানের লোকেরা শুধু ওষুধ বিক্রি করে না, অনেক সময় পরামর্শও দেয়। গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যের এই অনানুষ্ঠানিক কিন্তু কার্যকর অবলম্বন–ওষুধ ব্যবসায়ী বা দোকানদার আজ দেশের কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তবে প্রশ্ন হলো: এই ভূমিকা কি স্বাস্থ্যবান্ধব, নাকি স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ? আর এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোথায়?  কেন ২০২৫ সালেও একজন কৃষককে রাতের অন্ধকারে অশিক্ষিত ওষুধ বিক্রেতার দ্বারস্থ হতে হয়? কেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই জরুরি ওষুধের প্রাথমিক মজুত? কেন গ্রামীণ ফার্মেসিগুলোকে নিয়মিত তদারকি করে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় না?

বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত খুচরা ওষুধের দোকান রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনুমান, অনিবন্ধিত বা বেআইনি ওষুধের দোকানের সংখ্যা নিবন্ধিত দোকানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। নিবন্ধিত দোকানের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় পরিচালিত হয়। তবে এখানে ৩০-৪০ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতারই যথাযথ লাইসেন্স নেই।  প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামবাসী প্রথমে ওষুধের দোকানেই যান। শুধু জটিল অবস্থায় যান হাসপাতালে।

এই বিস্তারের পেছনে আছে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংকট ও সামাজিক বাস্তবতা– গ্রামে অকার্যকর ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও উচ্চ ব্যয়, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের ঘাটতি, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা সংকট, সহজলভ্য ব্যবসার সুযোগ হিসেবে তরুণদের আকৃষ্ট করা, ওষুধের ওপর গ্রামীণ মানুষের উচ্চ নির্ভরতা।

এই ওষুধের দোকানগুলো অনেক সময় প্রান্তিক মানুষের জন্য একমাত্র চিকিৎসা অবলম্বন। অসুস্থতা বা উপসর্গের প্রথম প্রতিকার হিসেবে ফার্মেসিতে যান।  চিকিৎসকের কাছে নয়। এমন বাস্তবতায়, এই দোকানগুলো একটি ‘ফার্স্ট কনট্যাক্ট পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, সাশ্রয়ী চিকিৎসা ও জরুরি সেবা প্রাপ্তি। সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক অনেক দূরে থাকায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ওষুধের দোকানই একমাত্র ভরসা। জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটের সমস্যার মতো সাধারণ রোগে দোকানদাররা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের ফি ও ক্লিনিকের খরচ এড়িয়ে রোগীরা সস্তায় ওষুধ কিনে নেন।

আর রাতের বেলা বা ছুটির দিনে যখন হাসপাতাল বন্ধ, তখন ওষুধের দোকানই একমাত্র বিকল্প। গ্রামের মানুষ জ্বর, সর্দি, পেটের সমস্যার জন্য এই দোকানে যায়। দোকানগুলো বাড়ির কাছে থাকে, তাই দ্রুত ওষুধ পাওয়া যায়। এই দোকানগুলো অনেক সময় রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। কিছু দোকানের লোক প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারা রোগীদের কীভাবে ওষুধ খেতে হবে, কীভাবে রাখতে হবে, তা বলে দেয়। এটা রোগীদের জন্য ভালো, কারণ তারা ওষুধ ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু ওষুধের দোকানের সব কাজ ভালো নয়। অনেক দোকানে নিয়ম মানা হয় না। কিছু দোকানের লোকের ঠিকমতো প্রশিক্ষণ নেই। তারা শুধু অভিজ্ঞতা থেকে কাজ শিখেছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো দোকানদারদের প্রভাবিত করে। তারা দোকানদারদের বলে তাদের ওষুধ বেশি বিক্রি করতে। এতে দোকানদাররা রোগীর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বা ভুল ওষুধ বিক্রি করে। এটা রোগীদের জন্য ক্ষতি করে। আরেকটা সমস্যা হলো, অনেক মানুষ নিজে নিজে ওষুধ কিনে খায়। তারা বন্ধু বা পরিবারের কথা শুনে ওষুধ খায়। দোকানদাররা এই চাহিদা পূরণ করে।

মোটাদাগে এসব ওষুধের দোকানের নেতিবাচক প্রভাব ও ঝুঁকিগুলো হলো অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত পরামর্শ, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বিক্রি, নকল ও ভেজাল ওষুধের বিস্তার এবং গ্রামের মানুষের মাঝে স্ব-চিকিৎসার প্রবণতা বৃদ্ধি। চিকিৎসা বিষয়ে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার কারণে তারা রোগ নির্ণয়ে ভুল করতে পারেন, যা রোগীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে। অন্যদিকে মুনাফার জন্য অনেক দোকানদার প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েডের মতো ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে। গ্রামের এসব ওষুধের দোকান  নকল ও ভেজাল ওষুধের বিস্তারে স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ডিজিডিএ) তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ বাজারে ২০-৩০ শতাংশ ওষুধ নিম্নমানের বা ভেজাল। আর দোকানদারদের ওপর নির্ভরতা বাড়ায় মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া কমিয়ে দেয়। ফলে জটিল রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়।

বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ১৯৪০ সালের আইন, ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ এবং বাংলাদেশ ওষুধ ও প্রসাধনী আইন ২০২৩। কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ প্রায় অনুপস্থিত। ২০২৪ সালের এক হিসেবে, দেশে মাত্র ৩৫০ জন ড্রাগ ইন্সপেক্টর ছিলেন। প্রতিজনকে গড়ে ৫০০টি দোকান তদারকি করতে হয়। ড্রাগ লাইসেন্স নবায়নে ঘুষ, দুর্নীতি এবং কাগজে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রমাণ ছাড়াও লাইসেন্স পেয়ে যাওয়ার বহু নজির রয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণের জায়গাটা একরকম অনিয়ন্ত্রিত। সম্প্রতি ওষুধ আইনে সরকার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং কঠোর করেছে। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন দুর্বল। আর  সরকার গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক বাড়ালেও সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। অনেক স্থানে সেবার মান নিম্ন। এছাড়া ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বিধান প্রতিটি ওষুধের দোকানে একজন প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এটি প্রায়ই অমান্য করা হয়।

তবে কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে ‘কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ দিয়ে ওষুধ ব্যবসায়ীদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। তবে এগুলোর ব্যাপ্তি সীমিত এবং ধারাবাহিকতা অনিশ্চিত। আবার, ড্রাগ ইন্সপেক্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি বা ডিজিটাল লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের গতি অনেক ধীর।

কাজেই এখন জরুরি হলো এসব দোকানির জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা, ডিজিটাল রেজিস্ট্রি চালু করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়া এবং কমিউনিটি ক্লিনিক ও ফার্মেসি সংযুক্ত করা। প্রতিটি দোকানদারের জন্য ১২ মাসের সরকারি স্বীকৃত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করতে হবে। প্রতিটি দোকান ও মালিকের তথ্য একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন ডাটাবেজে রাখতে হবে। তদারকি ও ইনস্পেকশন বাড়ানোর অংশ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও ওষুধ প্রশাসনের সমন্বয়ে যৌথ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার নিয়ে ক্যাম্পেইন চালানো দরকার।

“সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক নয়” এমন বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর প্রশিক্ষিত দোকানদারদের সরকারি তথ্য ও নির্দেশনার আওতায় এনে কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের সহকারী হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

ওষুধের দোকান বর্তমানে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। একে অবজ্ঞা না করে, তথ্য ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তিশালী সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলাই হবে বুদ্ধিমান কৌশল। প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসার এই অনানুষ্ঠানিক কাঠামোকে বৈধতা, জবাবদিহি ও সক্ষমতার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তি ঘটানোই এখন সময়ের দাবি। কেননা নিরাপদ, কার্যকর ও মানসম্পন্ন ওষুধ ও স্বাস্থ্য পণ্যের সাশ্রয়ী মূল্যের অ্যাক্সেস থাকলেই কেবল সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জন করা সম্ভব।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)।