পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের একতরফা অবস্থান ছিল। গত পাঁচ মাসের অব্যাহত সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের গোলযোগে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সমাধানের যেকোনও আলোচনায় নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে রাখলো। সিরিয়ায় সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটা সমাধানে আসার প্রক্রিয়া শুরু হউক ভ্লাদিমির পুতিন সম্ভবতো তাই কামনা করছেন। বাশারের বিজয় শতভাগ নিশ্চিত হলে তার কারণে হয়তো সমাধান প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবে তাই রাশিয়া নিজেকে গুটিয়ে রাখলো। রাশিয়া এরই মাঝে বাশার আল আসাদকে জানিয়ে দিয়েছে বাশার আল-আসাদ তার সামরিক বিজয়ের জন্য রুশদের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা উচিৎ হবে না- তাকে রাজনৈতিক সমাধানের কথা চিন্তা করতে হবে। তিনি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আপোসে আসার জন্য বাশারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট সিরিয়ার যুদ্ধকে সব সময় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে অবহিত করে আসছেন। কিন্তু রাশিয়া সিরিয়ার যুদ্ধকে সব সময় গৃহযুদ্ধ বলে অবহিত করেছেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সব পক্ষই সিরিয়ার মানুষ- সে বিষয়ে রাশিয়া সচেতন। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো না গেলে সিরিয়ায় স্থায়ী শান্তি যে সম্ভব নয় এ কথা তো বাস্তব সত্য। বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপে যুদ্ধের চিত্রটা ভিন্নরূপ নিলেও যুদ্ধটা যে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এটা যে গৃহযুদ্ধ- রাশিয়ার এ উপলব্ধি বাস্তব সম্মত।
রাশিয়া যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। সিরিয়ান কুর্দীরা আইএস-এর বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তারা সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের সীমান্তের কাছে সিরিয়ার অভ্যন্তরে স্বায়ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্ভবতো এ উদ্যোগের প্রতি রাশিয়া ও সিরিয়ার উভয়ের সমর্থন রয়েছে। কারণ কুর্দীদেরকে মস্কোয় অফিস খোলার অনুমতি দিয়েছে রাশিয়া। কুর্দীদের স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল টিকিয়ে রাখতে হলে রাশিয়ার সমর্থনের প্রয়োজন। কারণ তুরস্ক মনে করে যে এখন তো স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গড়ে উঠলে তুরস্কে বেআইনি ঘোষিত কুর্দীস্তান ওয়ার্কারস পার্টি এবং সিরিয়ার কুর্দী পপুলার প্রোটেকশান ইউনিট যৌথভাবে কুর্দীস্থান প্রতিষ্ঠার যুদ্ধকে বেগবান করবে। তুরস্ক এ যাবৎ যতবারই সিরিয়া আক্রমণ করেছে প্রতিবারেই তাদের টার্গেট ছিল সিরিয়ান কুর্দীরা। আবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ ফ্রি-সিরিয়ান আর্মিদেরকে মস্কোয় ডেকেছেন আলোচনা করার জন্য। ফ্রি-সিরিয়ান আর্মিরা হচ্ছে বাশারের সামরিক বাহিনী থেকে সরে যাওয়া সৈন্য। তারা অধিকাংশ সুন্নি মতালম্বী। রাশিয়া বর্তমানে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো তাতে রাশিয়ার প্রতি বিদ্রোহীদের আস্থা বেড়ে যাওয়ার কথা এবং অনুরূপ অবস্থার উদ্ভব হলে রাশিয়া একটা গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয়।
আলোচনার জন্য বাশারের ওপর রাশিয়া যে চাপ প্রয়োগ করছে তা থেকে বাশারের অব্যাহতি পাওয়ার কোনও বিকল্প পথ আছে বলে মনে হয় না। বাশারের কাছে রাশিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য- রাশিয়া বাশারের পতন ঠেকিয়েছে কিন্তু চিরকালের জন্য কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। রাশিয়া যদি তার প্রভাব বলয় ব্যবহার করে সিরিয়ায় একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে পারে তবে তা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য উপকার হবে শুধু তা নয়, বিশ্বের মানুষও রাশিয়াকে বিরোধ মিটাবার একজন ব্রোকার হিসেবে গ্রহণ করবে।
সোভিয়েত এর পতনের পর রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব হারিয়ে ফেলেছিল। ন্যাটো সম্প্রসারিত হয়ে তার সীমান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। লিতোনিয়া, লাটভিয়া, ইসতোনিয়া পূর্বে সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতন্ত্র ছিল। ২০০৪ সালে তারাও ন্যাটোতে যোগদান করেছে। এই তিন প্রজাতন্ত্র পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হবে বলে আশঙ্কা করছে। কিন্তু ইউক্রেন যখন ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেয় তখন পুতিন এই উদ্যোগের প্রবল বিরোধিতা করেন, কারণ ইউক্রেনের ক্রাইমিয়ায় রাশিয়ার নৌঘাটির অবস্থান। ক্রাইমিয়া পূর্ব থেকে রাশিয়ার ভূখণ্ড ছিল। ১৯৫৬ সালে ক্রুশ্চেভ যখন প্রধানমন্ত্রী তখন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্রুশ্চেভও ছিলেন ইউক্রেনের লোক। সোভিয়েতের পতনের পর ইউক্রেন যখন সোডিয়েট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন ক্রাইমিয়া ইউক্রেনের অংশ হিসেবে থেকে যায়। রাশিয়া ইউক্রেন থেকে ৪০ বছরের মেয়াদে ক্রাইমিয়া ভাড়া নিয়েছিল।
ক্রাইমিয়ার জনগণ রুশ জনগোষ্ঠীরই অংশ। ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলও রুশ জনগোষ্ঠীতে বোঝাই। ইউক্রেইন যখন ন্যাটোতে যোগদান করতে চেয়েছিল তখন রাশিয়ার উস্কানিতে ইউক্রেনে এবং ক্রাইমিয়ার রুশজনগোষ্ঠী স্বাধীনতার দাবি তুলে। ক্রাইমিয়ায় গণভোট হয়, তাতে ক্রাইমিয়ার স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে তারা রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তখন সম্পূর্ণ ন্যাটো ও আমেরিকা ইউক্রেনকে সমর্থন করেছিল। ক্রাইমিয়ার ব্যাপারে রাশিয়া দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া মধ্যপ্রাচের বিষয়ে সক্রিয় হতে শুরু করে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তারা সিরিয়ায় বোম্বিং শুরু করে। আমেরিকা যতই অস্বীকার করুক রাশিয়া গত দুই বছর প্রমাণ করার চেষ্টা করছে তারও শক্তি আছে। সোভিয়েত ভেঙে গেলেও রাশিয়া সুপার পাওয়ারের তেজ হারায়নি।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com