দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আমাদের মাঝে চলে এসেছে মহান ত্যাগের স্মারক ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ। কোরবানি মানি ত্যাগ। মুমিনের প্রতিটি জায়গায় ত্যাগ। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ। পৃথিবীতে সফলতা ও পরকালের মুক্তি ত্যাগের মাঝেই নিহিত। কোরবানি মূলত মনের ত্যাগ। জাকাত ও সদকা আর্থিক ত্যাগ। নামাজ রোজা শারীরিক ত্যাগ। আর্থিক ও শারীরিকদের ত্যাগের চেয়ে মনের ত্যাগেই বড় পরীক্ষা। মনে অনেক কিছু চায়, তা ত্যাগ করা আমরা মানুষ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। মক্কার কাফের সম্প্রদায় মনের থেকে বস্তুর পূজা ত্যাগ করতে পারেনি ইসলামের বিপক্ষে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। তবুও মনের মাঝে এক আল্লাহর বিশ্বাস ও আল্লাহর সাথে কারো শরিক নেই এটি স্থাপন করতে পারেনি। কোরবানির পশু জবাইয়ের মাধ্যমে ধন-সম্পদের মায়া মোহ ত্যাগের পাশাপাশি মনের পশুকে কোরবানি দেওয়ার শিক্ষাই আমাদেরকে দিয়েছেন মহান রব্বুল আলামীন। তাইতো আল্লাহ পাক কোরআনে বলেন, তোমাদের কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায়নি। বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছায়। (আল কোরআন)
তাকওয়ার সম্পর্ক মনের সাথে। আমাদের মনে কী আছে, একমাত্র আমরা নিজের মনের খবর জানি এবং মহান রব জানে। কোরবানি গতানুগতিক কোনও আনুষ্ঠানিকতা নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার নামই কোরবানি।
কোরবানি কী?
হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত জায়েদ বিন আরকাম (রা.) বলেন, সাহাবীগণ আল্লাহর রাসূলকে প্রশ্ন করলেন, আল্লাহর রাসূল এই কোরবানি কী? প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) উত্তরে বললেন, কোরবানি হচ্ছে আমাদের মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নত। সাহাবিগণ বললেন, এই সুন্নত পালনে আমাদের উপকারিতা কী? আল্লাহর রাসুল বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে নেকি ও পুণ্য পাওয়া যাবে। (আল হাদিস)
কোরবানি একটি ওয়াজিব আমল:
কোরবানি একটি ওয়াজিব আমল। এর অনেক সাওয়াব ও নেকি রয়েছে। যাদের ওপরে ওয়াজিব নয় তারাও যদি কষ্ট করে কোরবানির আমল পালন করেন তাহলে এই সওয়াবগুলো পাবেন। ইনশাআল্লাহ।
কোরবানি একটি সাধারণ আমল নয়:
আমরা অনেকে কোরবানিকে একটি সাধারণ আমল মনে করে থাকি। মনে করি করলে সওয়াব হবে। না করলে কোনও ক্ষতি নেই। সাধারণত কোনও ঋণে পড়ে গেলে বড় গরু কোরবানি করতে হবে এই মনে করে কোরবানির আমল আমরা অনেকে ছেড়ে দেই। মনে রাখতে হবে কোরবানি একটি ওয়াজিব আমল, ছোট খাসি দিয়েও আমাদের এই আমল উদযাপিত করা সম্ভব। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি ছোট খাসি একটি কোরবানি করে দিব। কোরবানির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা নয়। হাজার দশকের মধ্যেও দেওয়া সম্ভব।
কোরবানি হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্য:
একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি দিতে হবে। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক কোরবানির অর্থ হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোনও প্রিয় বস্তু আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা ও শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় তার ব্যবহার করা। আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরিফে এরশাদ করেন, “তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ো ও কোরবানি করো।” (সূরা কাউছার, আয়াত: ২) এ আয়াতে নামাজ ও কোরবানিকে এক সঙ্গে উল্লেখ করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নামাজ যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে পড়া যায় না; কোরবানিও অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা যায় না। একমাত্র আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে হবে।
কোরবানি হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য:
আমরা বিভিন্ন নিয়তে কোরবানি করে থাকি। কেউ কোরবানি করি সামাজিক মর্যাদা হিসাবে। সমাজে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, সুতরাং কোরবানি না দিলে মর্যাদা থাকবে না; এমন মনোভাব থাকে কারো কারো। কেউ কোরবানি করি চক্ষু লজ্জা থেকে বাঁচতে। কেউ কোরবানি করি গোস্ত খেতে। এ জাতীয় উদ্দেশ্যে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। বরং আমি ছোট ও বড় যে পশুই কোরবানি করি তা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়, অন্য কোনও উদ্দেশ্যে যেন না হয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে ঘোষণা করেন, “এগুলোর গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।” ( সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
কোরবানি হবে একমাত্র আল্লাহর নামে:
সাধারণত আমাদের সমাজে ব্যক্তির নামে কোরবানির কথা বলা হয়। যেমন, অমুকের নামে, বাবার নামে অথবা মায়ের নামে কোরবানি দিবো। এমনটি বলা ঠিক নয়। কারণ কোরবানি একটি আর্থিক ইবাদত, যা হবে আল্লাহর নামে, ব্যক্তির নামে নয়। এজন্য বলা যেতে পারে অমুকের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি। যদিও কারো নামে কোরবানির দ্বারা তার পক্ষ থেকে আদায় করা উদ্দেশ্য হয়, তারপরও এমনটি বলা উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন, “তোমরা তা ভক্ষণ করো না যেগুলো আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করা হয়।” (সূরা আনআম, আয়াত: ১২১)
হাসিলের সাথে কোরবানির কোনও সম্পর্ক নেই:
অনেকে মনে করেন হাসিল না দিলে কোরবানি হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। হাসিল হাটের ভাড়া। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেওয়া হয়। তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গোনাহ হবে।
নিজের পশু নিজেই জবাই করা:
অনেকে মনে করেন ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্র দ্বারা জবাই করা জরুরি। আসলে বিষয়টি এমন নয়। বরং নিজে জবাই করা মুস্তাহাব। অক্ষম হলে অন্য কোনও মুসলমান দিয়ে জবাই করা যেতে পারে। তবে ইমাম, আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসার কারণে তাদের দ্বারা কোরবানি করালে দোষের কিছু নেই। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কোরবানি করেছেন ও বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন। ( বুখারি শরিফ)
কোরবানি দাতাদের নামের তালিকা পাঠ করা কোনও প্রয়োজন নেই:
কোরবানির সময় দাতাদের নাম কাগজে লিখে হাতে নিয়ে পাঠ করাকে অনেকে জরুরি মনে করেন। অথচ কোরআনও হাদিসে এর কোনও ভিত্তি নেই। বরং যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি হচ্ছে তা আল্লাহ তায়ালা ভালো করে জানেন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরিফে বলেন, “নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়।” (সূরা আ’লা, আয়াত: ৭)
জবাইকারী ও তার সহযোগীদের বিসমিল্লাহ পড়া জরুরি:
জবাইকারী ও তার সাথে সহযোগীরা যদি জবাইয়ের সময় ছুরিতে হাত লাগায় তাহলে প্রত্যেককে বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এদের কেউ যদি ইচ্ছাপূর্বক জবেহ এর সময় বিসমিল্লাহ না পড়ে তাহলে পশু কোরবানি হবে না। (ফতোয়া শামি:৬/৩৩৪)।
আমরা অনেকেই এ মারাত্মক ভুল করি।
জবাইয়ের সময় পশুর চারটি রগের তিনটি কাটা নিশ্চিত করা:
অনেক সময় জবাইকারী একটু জবাইয়ের পর কসাই ভাইয়েরা ছোট ছুরি দিয়ে পশুর গলায় জোরে আঘাত করেন; এটি সম্পূর্ণ নাজায়েয ও গর্হিত কাজ। এতে পশু জবাই হলো না বরং আঘাতে হত্যা করা হলো। এজন্য প্রাণীর চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটা নিশ্চিত করতে হবে। চারটি রগ হলো শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি রক্তনালি বা শাহরগ।
চামড়া খাওয়া যাবে কি?
জানি একটি বিস্ময় আমাদের সামনে এসেছে অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন পশুর চামড়া খাওয়া যাবে কি? মনে রাখতে হবে যেসব পশুর গোশত খাওয়া হালাল সেই সব পশুর ৭টি জিনিস খাওয়া যায় না।
তা হলো- প্রবাহিত রক্ত, পিত্ত, মূত্রথলি, মাংসগ্রন্থি, নর-মাদি পশুর গুপ্তাঙ্গ এবং অণ্ডকোষ। (বায়হাকি)।
যে সাতটি বিষয় খাওয়া যায় না এর মধ্যে চামড়া নেই। কারো যদি রুচিতে ধরে তাহলে চামড়া খেতে পারে। আর রুচিতে না ধরে তাহলে, সে নাও খেতে পারে। সবার সব জিনিস রুচিতে আসবে এমনও নয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে যেভাবে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কোরবানি দিয়েছিলেন মহান রবের দরবারে, সেভাবে কোরবানি করা তৌফিক দান করেন।
লেখক: খতিব, পীর ইয়ামেনী জামে মসজিদ, গুলিস্তান, ঢাকা