আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস। প্রতিবছর এ দিনে আমি একটি নিবন্ধ লিখি এবং ফি-বাৎসারিক থিমের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে দেখার, বোঝার এবং অন্যকে বোঝাবার চেষ্টা করি। এ-বছরের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “শরণার্থীদের সাথে সংহতি”। এখন সংহতিকে যদি আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় নিই, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘রোহিঙ্গার সাথে সংহতি’। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সাথে সংহতি বলতে আদতে কী বোঝায়, সেটা এ নিবন্ধে বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আলোচনার সূত্র ধরে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এটা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে প্রতি বছর ‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস’ পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন বড় আকার ধারণ করলেও বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনের কোনও আয়োজন এবং তৎপরতা আমরা খুব একটা দেখি না। হয়তো, কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, বাংলাদেশ তো ১৯৫১ সালের আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র নয়; সুতরাং বাংলাদেশ কেন বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করবে? কিন্তু এ বাস্তবতাকেও আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র না হয়েও যদি প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জায়গা দিতে পারে, সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে বাংলাদেশে কী ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে সেটা এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থাপন করলে আখেরে বাংলাদেশেরই লাভ।
কাজেই এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশেও বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি ইতোপূর্বে একটি লেখায় লিখেছিলাম, “বিশেষ করে ২০১৭ সালের পর একটা বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী (প্রায় সাড়ে ৭ লাখ) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জেনোসাইড থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর শরণার্থী বিষয়ক আলোচনায় বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের নামও এখন সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
২০১৭ সালের আগে রোহিঙ্গারা এ দেশে ছিল না, বিষয়টি তা নয় (প্রায় ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস ছিল)। কিন্তু ২০১৭ সালের পর বিষয়টির তীব্রতা, ভয়াবহতা এবং গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রা নেওয়ায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও শরণার্থী বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশের নাম অনিবার্যভাবে হাজির হয়। কেননা, শরণার্থী বসবাসের ঘনত্বের বিবেচনায় উখিয়ার কুতুপালং এখন সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ের জেনোসাইডের উদাহরণ হিসাবেও রোহিঙ্গাদের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গণহারে আলোচনা আসে।” কিন্তু বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনও ধরনের দৃশ্যমান নড়াচড়া আমাদের চোখে পড়ে না।
এখানে প্রসঙ্গত লেখা বাহুল্য, বাংলাদেশ যে দাবি করে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনে বাংলাদেশ কোনও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তখন তো বাংলাদেশ নামের কোনও রাষ্ট্রও ছিলে না। এমনকি ১৯৬৭ সালে শরণার্থী বিষয়ক প্রটোকলেও স্বাক্ষর করার জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কোনও অস্তিত্বও ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি। এটাও কোনও বাহাদুরির বিষয় নয়।
আপনি বাংলাদেশ প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে (যদিও এদেরকে সরকারি ভাষায় শরণার্থী বলা হয় না, কিন্তু সেটা কোনও পার্থক্য কি আদৌ উৎপাদন করে?) হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহায়তায় এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, অথচ আপনি বাংলাদেশে কোনও শরণার্থী নাই বলে জাহির করছেন, এর মধ্য দিয়ে মৌলিক কোনও উপকার রাষ্ট্রের হয় না। বরং, এটা দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশে কোনও সুনির্দিষ্ট শরণার্থী পলিসি নাই এবং বাংলাদেশ এখনেও ১৯৫২ সালের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র নয়।
২০০১ সালের ২০ জুন থেকে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়ে আসছে। তার মানে, এর আগে কি পৃথিবীতে শরণার্থী ছিল না? অবশ্যই ছিল, কিন্তু ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন স্বাক্ষরের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০১ সাল থেকে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করা শুরু হয়। প্রতিবছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসের জন্য জাতিসংঘ একটা ঘোষণাপত্র তৈরি করে এবং একটা থিম বা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। ২০২৫ সালের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “ Solidarity with Refugee”। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “শরণার্থীদের সাথে সংহতি”।
কবে, কখন, কীভাবে শরণার্থী দিবস পালনের রীতি চালু হয় এবং এর নানান পথ পরিক্রমা নিয়ে আমি প্রায় প্রতি বছর নিয়মিতভাবে লিখেছি। আজকে শুধু রোহিঙ্গাদের সাথে সংহতির বিষয়টি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।
একথা অনস্বীকার্য যে, প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগণ নানা সমস্যার সাক্ষাৎ ভুক্তভোগী। ফলে, স্থানীয় জনগণের মধ্যে রোহিঙ্গা বিরোধী একটা দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব মোটাদাগে বেড়ে উঠছে। এবং এটা অনস্বীকার্য যে, এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে একটা বাস্তবতা ও ন্যায্যতা আছে। তাছাড়াও রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে বৈদেশিক সাহায্য ক্রমহ্রাসমান হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও একটা চাপ পড়ছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের আর এদেশে রাখতে চাচ্ছে না। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশের আসে, তখন যে উত্তেজনা এবং উৎসাহ নিয়ে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করছিল, সেখানেও ক্রমান্বয়ে ভাটা পড়েছে। আফগান শরণার্থী সমস্যা, ইউক্রেনিয়ান শরণার্থী এবং অন্যান্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সমস্যা প্রভৃতি নিয়ে এরা এখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনও মাথা ব্যথা নাই। আবার মিয়ানমারের নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ নানান সংকটের কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত কোনও ফলপ্রসূ আলোচনার কোনও আলামতই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু যে প্রশ্নটা আমাদের মাথায় রাখা জরুরি, সেটা হচ্ছে এই যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিকারহীনতা এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার কোনও আশাব্যঞ্জক তৎপরতার অভাব, এজন্য কি আমরা রোহিঙ্গাদের দায়ী করতে পারি? বেচারা রোহিঙ্গাদের অপরাধটা কী? তারা তো শখ করে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেনি। তারা একটা জেনোসাইডের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা একটা জেনোসাইডাল পরিস্থিতির শিকার। তাদের আছে অত্যন্ত ভয়ংকর অতীত, জটিল বর্তমান এবং একটা চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এরকম একটা পরিস্থিতিতে উল্টো যদি আমরা রোহিঙ্গাদেরকে আসামি ও অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, তাহলে সেটা কি খুব ন্যায্য ও মানবিক হয়? এটাকেই একাডেমিক ভাষায় বলে “ব্লেইমিং দ্য ভিকটিমস”!
রোহিঙ্গাদের প্রতি এতটুকু সমবেদনা যেন আমরা পোষণ করি, এটাই আজকের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। আমি কেবল এ প্রতিপাদ্যকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম। এটা আমরা সবাই বিনাবাক্যে স্বীকার করি যে, দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ সবার আগে। কিন্তু এটাও মনে রাখা জরুরি যে, আগে মানুষ ও মানবতা; তারপর রাষ্ট্র।
লেখক: ভিজিটিং স্কলার, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যঅলয় ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।