‘এটা নিয়ে লিখলেন, ওটা নিয়ে কেন লিখলেন না?’

প্রতিদিন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। যা কিছুই লিখি না কেন, প্রশ্ন আসে একই রকম। ‘এটা নিয়ে লিখলেন, ওইটার সময় তো চুপ ছিলেন। তখন তো কিছু বলেননি।’
কেউ প্রশ্ন করেন প্রত্যাশা থেকে। কেউ অভিযুক্ত করেন এভাবে যে, কোনও কোনও প্রসঙ্গ ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে গেছি।
এই লেখা না লেখার প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা।
১. তনু ধর্ষণ-হত্যা নিয়ে দেশের মানুষ কতটা বিক্ষুব্ধ, তা এই আন্দোলন থেকে অনুমান করা যাবে বলে মনে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়। আন্দোলনে কিছুটা দেখা যায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে পুরোটা অনুধাবণ করা যায়। সেটা অনুধাবণ করার ইচ্ছে বা সময় সরকারের আছে, এমনটা ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই।
তনুকে নিয়ে যখন লিখলাম তখন একজন প্রশ্ন করলেন, ‘কৃষ্ণকলি ও তার স্বামীর বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম নিরব কেন?’ আরেকজন অভিযুক্ত করলেন, ‘কৃষ্ণকলি ও তার স্বামী যে গৃহকর্মী হত্যা করলো, তা নিয়ে তো আপনারা কিছু লিখবেন না, বলবেন না। কারণ তারা তো আপনাদেরই লোক।’
আপনারা প্রত্যাশা করছেন, মনে করছেন কৃষ্ণকলি ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে আসা গৃহকর্মী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে লেখা উচিত। আমিও একমত, লেখা উচিত। কিন্তু আমি তো তনু ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের বিভৎসতা থেকে বের হতে পারছি না। তনু উনিশ বছর বয়সী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সন্তান। জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই মানুষটিকে এভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো? হত্যাকারী কারা? তাদের চেহারা কি মানুষের মতো? এরা কথা বলে, ভাত খায়? এরা কারও সন্তান, কারও বাবা, কারও ভাই?
তনুকে ক্ষত-বিক্ষত করে যারা ধর্ষণ-হত্যা করলো, তারা অক্ষত থেকে যাবে? তদন্ত-বিচার কিছুই হবে না? প্রহসন দেখতে হবে?
এই প্রশ্নের গণ্ডি থেকে তো বের হতে পারছি না। এর মধ্যেই চলে এলো কৃষ্ণকলি প্রসঙ্গ। তনুই তো মাথা জ্যাম করে রাখলো। কৃষ্ণকলি ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে আসা এই অভিযোগ নিয়ে লিখবো কখন, কীভাবে!
না লেখার অজুহাত দেখাচ্ছি না, বাস্তবতার কথা বলছি। একটির বিভৎসতা কাটার আগেই, আরেকটি বিভৎসতা জাপটে ধরছে।
২. অভিযোগ এসেছে, ফেনির তুলসি রাণীকে নিয়ে তো কিছু লিখলাম না। হ্যাঁ লিখলাম না, লিখিনি, লিখতে পারিনি। একমত, লেখা উচিত ছিল। মাইকিং করে গোপালগঞ্জের যে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, তা নিয়েও তো কিছু লিখলাম না।

এমন না লেখার তালিকা দীর্ঘ। কিছু লিখলাম না বলে, যা লিখলাম তা কি অপরাধের পর্যায়ে পড়বে?

লিখেছিলাম পূর্ণিমাকে নিয়ে। মনে পড়ে পূর্ণিমাকে? কিশোরী পূর্ণিমার রঙিন ছবি দিয়ে আর্ট পেপারে বই-বই ছাপানো হয়েছিল। দেশে-বিদেশে বিলি করা হয়েছিল। তা ধর্ষণের চেয়ে কম ভয়াবহ ছিল না পূর্ণিমা ও তার পরিবারের কাছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্ষিত হয়েছিল, সেই পূর্ণিমার কথা বলছি।

পূর্ণিমাদের অত্যাচার-ধর্ষণ-নিপিড়ণের অভিযোগ ছিল বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে। এই ঘটনা-আন্দোলনের সুফল ভোগ করেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার গত সাত বছরে আওয়ামী লীগ কি পূর্ণিমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে? আমরা তো লিখেছিলাম, প্রতিবাদ করেছিলাম। আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছিল পাশে দাঁড়ানোর। কথা রাখেনি।

লিখেছি সংখ্যালঘুর থেকে মন্ত্রী কর্তৃক কিনে নেওয়ার নামে বাড়ি কেড়ে নেওয়ার কথা। লিখেছি পাবনার সাথিয়ার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর আক্রমণের কথা। তদন্ত-বিচার কিছুই হয়নি।

অভয়নগর থেকে চট্রগ্রামের বৌদ্ধপল্লী বা খাগড়াছড়ির মহালছড়ি গ্রামের ধর্ষণ-হত্যা-জ্বালাও-পোড়াও, কত ঘটনা-কত লেখা! কোনও ঘটনার তদন্ত-বিচার হয়নি।

বৌদ্ধপল্লীর জ্বালিয়ে দেওয়া ঐতিহ্যবাহী পুরনো মন্দিরগুলোর স্থানে চকচকে নতুন মন্দির নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, অপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে। নতুন বিল্ডিংয়ে কী মনের ক্ষত দূর হয়!

সুতরাং কী লিখলাম না, সেই প্রশ্ন তোলেন -আপত্তি করবো না। তার চেয়ে বড়ভাবে প্রশ্ন তোলেন সরকারের ভূমিকা নিয়ে। যা লিখেছি তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অভিযুক্ত করেন সরকারকে। সরকারকে বাদ দিয়ে ‘এটা লিখলেন ওটা লিখলেন না’ অভিযোগ তুলে পাশ কাটানো কূট-কৌশল পরিত্যাগ করা বাঞ্চণীয়।

৩. অনেক বছর আগের কথা। ওসমানি উদ্যানের গাছ নিধনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মণীষীতুল্য মানুষ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তারপর আরও অনেক জায়গায় গাছ নিধন হয়েছে সরকারের উদ্যোগে বা প্রশ্রয়ে। তখন বারবার করে বলা হয়েছে ‘অমূক জায়গার গাছ বাঁচানোর জন্যে তো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গেলেন না?’
বিষয়টি যেন এমন যে, যেখানেই গাছ নিধন করা হবে সেখানেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে গিয়ে আন্দোলন করতে হবে। বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। বিষয়টি এমন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটি কাজ করেছেন, সেটা দেখে আপনিও আর একটি কাজ করেন। প্রশ্ন করেন, অভিযোগ করেন, প্রত্যাশার কথা বলেন, সঙ্গে কাজটিও করেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটি কাজ করছেন না বা করতে পারছেন না বলে, তার করা আগের কাজটি অপরাধ নয়।

যারা প্রত্যাশা করছেন বা ‘এটার সঙ্গে ওটা’ মিলিয়ে অভিযুক্ত বা প্রশ্ন করছেন তাদের মনে রাখা দরকার, আপনি কী করছেন? আপনি কী সব বড় বড় অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি সমর্থন করছেন? বা এসব বিষয়ে নিরব থেকে ‘ফুল-পাখি-লতা’ নিয়ে লিখছেন, কথা বলছেন?

নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন। হয়ত উত্তর পেয়ে যাবেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘গীতবিতান’ লিখেছেন। গীতবিতান নিয়ে প্রশংসা, আলোচনা, সমালোচনা হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কেন ‘শেষের কবিতা’ লিখলেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বা ‘কবি’ লিখলেন না কেন- মোটামোটি জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন সুস্থ কোনও মানুষ এমন প্রশ্ন কখনও করবেন না। হুমায়ুন আহমেদ যা লিখেছেন, তা দিয়েই তাকে বিচার করতে হবে। কী লিখতে পারতেন, তা দিয়ে নয়। আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি সব কিছু করলেন না বা করতে পারলেন না বলে, তিনি যা করেছেন অন্যায় করেছেন- এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়।

৪. তনু ধর্ষণ-হত্যা নিয়ে আজকে (৩০ মার্চ) পর্যন্ত যা ঘটছে, তার পুরোটাই গভীর হতাশার। অপরাধী সনাক্ত বা ধরার তৎপরতা নেই। উল্টো তনুর বাবা-মাকে মাঝরাতে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে, কার সঙ্গে তনুর ‘সম্পর্ক’ ছিল? যা শুধু অমানবিক না, আইনসিদ্ধও নয়।

ঘটনাটি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঘটায় সামরিক বাহিনীর নাম এর সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভেতরে ঘটেছে বলেই সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জড়িত, তা বলে দেওয়া যায় না। তবে তদন্ত ঠিক মতো না হলে, দায় এড়ানোও যায় না।

মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, তনু ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কথা না বলতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে নিষেধ করা হয়েছে। অভিযোগটি গুরুতর। র‌্যাব কর্তৃক তনুর বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো অপরাধী কে বা কারা? নিশ্চয়ই পুরো ক্যান্টনমেন্ট বা পুরো সামরিক বাহিনী নয়। সামরিক বাহিনীর এক বা একাধিক সদস্য জড়িত থাকতে পারেন। যদিও তদন্তের আগে তা বলা যাবে না। এখন সেই তদন্ত যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কথা বলতে যদি নিষেধ করা হয়, সামরিক বাহিনীর কোনও বক্তব্য যদি পাওয়া না যায়, তা সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তির জন্যে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। শান্তি মিশনে ধর্ষণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের সামরিক বাহিনী নিশ্চয়ই সে বিষয়ে সতর্ক আছে। এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র কিনা, ভেবে দেখা জরুরি। সামরিক বাহিনী একটি সুশৃঙ্খল প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান। আইন অমান্য বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা সেখানে বিদ্যমান আছে।
তনু হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অত্যন্ত অপেশাদার এবং অগোছালো ভাবে হ্যান্ডেল করা হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন সেকারণেই আসছে।

৫. তনু ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে একটু কম গুরুত্ব পেলেও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ আসছে। দেশে আন্দোলন চলছে। ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদটি আরও বড় ভাবে আসার সম্ভাবনা থাকছে। তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে হয়ত বাহিনীর দু’চারজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তদন্ত সঠিকভাবে না হলে পুরো বাহিনীর উপর দায়ভার বর্তাবে। যা কারোরই কাম্য হতে পারে না। বিষয়টি সবারই বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সেই বিবেচনায় নেওয়ার সঙ্গে ধমকের বা তদন্ত না করে চাপা দেওয়া বা ‘জর্জ মিয়া’ সন্ধানের কোনও সম্পর্ক থাকা প্রত্যাশিত নয়।

৬. ‘এটা করলেন, ওটা কেন করলেন না’- প্রত্যাশা করতেই পারেন, অভিযুক্ত করবেন না। এদেশে একটি অঘটনের রেশ কাটার আগেই আরেকটি বা একাধিক অঘটন ঘটে। অথবা একটি চাপা দেওয়ার জন্যে আরেকটি ঘটানো হয়। আট ‘শ কোটি টাকা চুরির ঘটনা ছাপিয়ে আলোচনায় চলে এলো তনু ধর্ষণ-হত্যা। এই আলোচনা থাকতে থাকতেই, আবার কী ঘটবে আমরা জানি না। ফলে কারও পক্ষেই এদেশে সব ঘটনা নিয়ে সমান প্রতিক্রিয়া দেখানো সম্ভব নয়।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক