সব কিছু ভেঙে পড়ে

আহসান কবিরহুমায়ুন আজাদ তার এক উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন সব কিছু ভেঙে পড়ে। তারও বহু আগে আমাদের শেখানো হতো- অপরূপভাবে ভাঙা গড়ার চেয়ে মূল্যবান কখনও-সখনও। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-কারার ওই লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল কররে লোপাট! নজরুলের বইয়ের নাম আছে- ভাঙার গান। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানের কথা এমন- ভেঙে মোর ঘরের চাবি/নিয়ে যাবি কে আমারে? ব্যান্ডের গানের অ্যালবামের নাম আছে-ভাংচুর প্রেম।
বাংলা ছবির গানে আছে-ভেঙেছে কতোজন/ভেঙেছে কত মন/সবই তো নারীরই কারণ/আমিতো তাদেরই একজন।। নারী ঘটিত কারণে কি কখনও রাজনৈতিক দল ভাঙে? নারীর কারণেও যে দল ভাঙে তা ইদানিং কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন। কোনও একজনতো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন- আম্বিয়া আর শিরীন এই দুই নারী শেষমেষ জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) ভেঙেছেন!
যিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি জানেন না (সম্ভবত তার বয়স বিশের বেশি হবে না। এই বয়সের কারও কাছে জাসদের কোনও স্মৃতি থাকার কথা না। ন্যূনতম সাতান্ন-আটান্ন অথবা তার চেয়ে বড় অনেকেই বিধ্বংসী অনেক স্মৃতিজাগানিয়া ঘটনা বলতে পারবেন! কত শত লোক যে জাসদ থেকে এই পর্যন্ত দলছুট হয়ে অন্যদলে ডিগবাজি খেয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। অন্য কোনও দল এই রেকর্ডও ভাঙতে পারবে না। জাসদও কয়েকবার ভেঙেছে। জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় আনা, সিপাহী বিপ্লবের নামে সেনা অফিসারদের হত্যা করা, ভারতের হাইকমিশনারকে জিম্মি করার চেষ্টা, এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে সংসদে আসম রবের গৃহপালিত বিরোধীদলে থাকা, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত আবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা, ২০০৯ থেকে রব সাহেবকে টপকে হাসানুল হক ইনু সাহেবের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার কারণে জাসদের অনেকেই এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জাসদের মূল শ্লোগান হচ্ছে ‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’, শুরু থেকেই আসলে এটা ছিল ‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক ষড়যন্ত্র!’) যে আম্বিয়া নারী নন, তার পুরো নাম শরীফ নুরুল আম্বিয়া। জাসদের শেষবার ভাঙনে তিনি মঈনদ্দিন খান বাদলের কাছাকাছি এসেছেন! ভাঙন শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলিয়া দেয়। আসম রব আর জিকু সাহেবের মতো শিরীন আপার অনেক দূরের মানুষ এখন শরীফ নুরুল আম্বিয়া।

জাসদের মতো ভাঙন অনিবার্য হলেও জাতীয় পার্টি এখনও ঝুলে আছে এরশাদ নামের ধনন্তরী(!) এক সুতোয়! ভেঙে যাওয়া জাসদের মতো জাতীয় পার্টিও ভেঙেছে পাঁচবার। বদলে যাওয়া জাসদের শ্লোগানের মতো জাতীয় পার্টির মূলমন্ত্রও হচ্ছে যেন- আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে যোগদানের জন্য দীর্ঘতম অনুশীলন। সবাই যেন সেরকম একটা দুঃসংবাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন!

তবে দল ভাঙার রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাও ছিল! পাকিস্তানি জেনারেল আইয়ুব খান কিংবা জিয়াউল হকদের দল গঠনের মতো দলছুট ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের নিয়ে এদেশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে।

আসলে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে যেন নিয়মিত বিরতি দিয়ে বাজে ভাঙার গান। কিছুদিন পর পরই খবর আসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিনেমা হলগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে! সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। 'জীবন থেকে নেওয়া' ছবির একটি বিখ্যাত গান আছে এমন-'এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?' আমরা খাঁচা ভাঙতে চাইলেও ক্রমাগত যেন বন্দী হয়ে যাচ্ছি সেই পুরোনো খাঁচাতেই!

ছোটোকাল থেকে শুনে আসছি নদী ভাঙে। একপাড় ভাঙলে নাকি অন্যপাড় গড়ে। চর জাগার খবরও পাওয়া যায় অহরহ। সেই চরের দখল নিয়ে হয় খুনোখুনি। পাড় ভাঙা নদীও দখল হয়। সম্মিলিতভাবে মানুষ সেই নদীকে দূষিতও করে তোলে। বছরের পর বছর যায়, কিন্তু এই দখলচক্র ভাঙা সম্ভব হয় না। খাঁচা ভাঙার মতো দখলচক্র কখনও ভাঙবে কিনা জানি না। তবে ঢাকার তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে জাকিয়ে বসা দখলচক্রকে শেষমেষ উচ্ছেদ করা গেছে। সেখানকার রাস্তাঘাটের সংস্কার হয়েছে, বানানো হয়েছে পাবলিক টয়লেট। জয়তু মেয়র (উত্তর) আনিসুল হক।

নিয়ম করে সংসার ভাঙার খবর পাই আমরা। শোবিজের সঙ্গে জড়িত নায়ক-নায়িকা গায়ক-গায়িকা কিংবা খেলোয়াড়দের সংসার ভাঙা-গড়ার খবর মুখরোচক করে পরিবেশন করা হয়। কৌতুকে আছে -বিয়ে হয় স্বর্গে কিন্তু ভাঙে হলিউড, বলিউড কিংবা ঢালিউডে! আবারও বাংলা ছবির গানের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। গানে আছে- হেলেন ভেঙেছে ট্রয় নগরী/কেউ ভেঙেছে সিংহাসন! সবই তো নারীরই কারণ!!

তবে বিশ্বখ্যাত গল্পগুলোর ভেতরেও ভাঙাভাঙির ব্যাপারটা আছে। মিউনিসিপ্যালিটির বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছেন এক লোক। তার অভিযোগ, ম্যানহোলে ঢাকনা ছিল না। একারণে তার পা ভেঙে গেছে (বহু পুরোনো গল্প হলেও বাংলাদেশে এটা এখনও কল্পনা করা যায় না) বিচারকের কাছে যাওয়ার পর ওই লোককে বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটা কে? লোকটা হতভম্ব। আসলে ওই বিচারকের কাছে বিচার চাইতে এলেই তিনি জানতে চাইতেন মেয়েটা কে? যেন মেয়েরাই সব নষ্টের মূল, সব ভাঙাভাঙির হোতাই তারা। যাই হোক গল্পের শেষে জানা যায়, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে এক বাড়ির ছাদে দাঁড়ানো এক মেয়ের দিকে নজর পড়ায় ওই লোক অমনোযোগি হয়ে পড়েছিলেন। ফলাফল ম্যানহোলে পড়া এবং পা ভাঙা!

তবে মন ভাঙাভাঙি নিয়ে এই পৃথিবীতে কতো যে গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা আর ছায়াছবি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা নাকি সমান কথা। কিন্তু নচিকেতার গানে আছে- 'ভেঙে গেলে জোড়া যায় মসজিদ মন্দির/ভাঙা কাঁচ ভাঙা মন যায় না!!' প্রেম ভালোবাসা আসলে মন ভাঙা গড়ার উপাখ্যান। কাব্যিক দোতনায় ভরা এই মন ভাঙাভাঙি নিয়ে বেশি কিছু না বলাই ভালো। যার ভাঙবে তিনিই বুঝবেন। তবে ক্ষমতার ঘর ভাঙলে হারানোর বেদনাটা নাকি সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়। কেউ কেউ অবশ্য ক্ষমতার ঘরকে তাসের ঘরের সঙ্গেও তুলনা করেন। তাসের ঘর ভেঙে পড়ে যখন তখন, বেশিক্ষণ টেকে না! হাসিনা আর খালেদা বহুদিন এমন ঘরেই বাস করে যাচ্ছেন। যিনি বিরোধীদলে থাকেন তার মুখ দেখেই বোঝা যায়, ক্ষমতার ঘর ভাঙার কী বেদনা!

রাষ্ট্র আসলে মানুষের পরিচয়বাহী সবচেয়ে বড় ঘর। সেই ঘরেও ভূমিকম্পের ছোঁয়া লাগে, কেঁপে ওঠে বিবিধ কারণে। এদেশে দুর্নীতি, লাম্পট্য আর স্বৈরাচারের মূর্ত প্রতীক এরশাদ সাহেব ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিলেন। তখন এরশাদ বিরোধিতার নামে প্রায় সব বিরোধীদল এর সমালোচনা করেছিল। এরশাদের পর মোটা দাগে বিএনপি ও তার সমমনা এবং আওয়ামী লীগ ও এর জোটবদ্ধ দলগুলো দুই দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশ শাসন করেছে। কেউ রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কোনও কথা বলেনি। আসলে রাষ্ট্র নিজে যখন বিশ্বাসের ভাইরাসে ভোগে, রাষ্ট্র নিজে যখন চালাকি করে, তখন সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও আরও বেশি চালাকির ফাঁদে পড়ে যায় রাষ্ট্র একদিন। সেদিন আর কেউ নষ্টদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে পারে না। বিশ্বাস ভাঙার বেদনা নিয়ে অন্য ধর্মের মানুষেরা তখন খুব অসহায় হয়ে রাষ্ট্রের ভেতর বেঁচে থাকতে বাধ্য হন! বিশ্বাস ভাঙার বেদনা আছে পার্বত্য অঞ্চলে যারা বসবাস করেন, সেই পাহাড়িদের ঘরে ঘরেও!

উন্নয়ন কিংবা আরও কিছু ভালো অর্জনের পরেও রাষ্ট্র যারা চালান তাদের দেওয়া (?) বিশ্বাস ভাঙার বেদনাও বাড়ছে ক্রমশঃ। গণতন্ত্র এখন সোনার হরিণ। গত ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এদেশে যত ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে স্বাধীনতার পর থেকে তা হয়নি! সোনালী ব্যাংকে (২০১২ সালে) আড়াই হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি, একই সময়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং তিন হাজার ছয়শত কোটি টাকা লোপাট হয়। বেসিক ব্যাংকে চার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির  ঘটনা দেশময় তোলপাড় তোলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও জনতা ব্যাংকে ২৫১ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পরে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আশি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় পদত্যাগ করতে হয় গভর্নর আতিউর রহমানকে! প্রশ্ন উঠেছে তিনি কার দায় এড়াতে পদত্যাগ করলেন? বেশিরভাগ মানুষ যারা জীবনের প্রায় সব সুখ বিসর্জন দিয়ে একটু ভালো ভবিষ্যতের আশায় দেশে কিংবা বিদেশে বসে টাকা কামিয়ে সঞ্চয়ের জন্য ব্যাংকে রাখেন কোন বিশ্বাসে তারা নতুন করে বুক বাধবেন?

বিশ্বাস ভঙের মতো আশা ভাঙার বেদনাও বেড়েছে ইদানিং! ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়ে এদেশবাসীর তেমন কোনও আশা ছিল না। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পরে নদীর বুকে চর জাগার মতো আশার দ্বীপও জেগে ওঠে। তারপর সীমাহীন বেদনার সময় আসে। বাংলাদেশের খেলা মানে নির্ঘাত বাংলাদেশের পরাজয়। কিন্তু সেদিনও বাসি হয়ে আসে। ২০১২-১৩ সাল থেকে বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু, বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম ক্রমশঃ ফিরে আসে জয়ের ধারায়। কিন্ত ২০১৬ সালের মার্চ মাসে এসে এশিয়া ও  বিশ্ব টি-টোয়েন্টি কাপের খেলায় পাকিস্তান ও ভারতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে খেলায় হেরে যায় বাংলাদেশ। আশা ভঙের বেদনা কেমন হতে পারে সেটা হাল আমলের ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখলেই যে কেউ বুঝবেন। ভারতের সঙ্গে ১ রানে হারার স্মৃতি আশা ভঙের করুণ বেদনা হয়ে মানুষের মনে থেকে যাবে বহুদিন!

তবে কোনও ডাস্টার দিয়েই জীবনের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে সোহাগী জাহান তনুর মুখটা মোছা যাবে না। বাবা-মা আর ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি টিউশনি করতেন। দেশটাকে বদলে দেওয়ার জন্য কিংবা নিদেনপক্ষে জীবনের সব কষ্ট ভোলার জন্য নিজেকে তিনি জড়িয়েছিলেন নাটকের সঙ্গে। টিউশনি করে ফেরার পথে ২০ মার্চ রাতে (২০১৬) নির্মমভাবে তাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, তার লাশ পাওয়া যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের পাওয়ার হাউস এলাকায়! দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরীরা প্রথম থেকেই নিশ্চুপ থাকে, সারাদেশ জেগে ওঠার পর তাদের নড়াচড়া চোখে পড়ে! ততোদিনে তনুর লাশ কবর থেকে আরেকবার ময়নাতদন্ত করার জন্য তোলা হয়ে গেছে, কবরস্থানসহ আরও কতো প্রমাণ যে নষ্ট করা হয়েছে, সেটা আমরা এখনও জানি না! জানি না নতুন কোনও জজ মিঞা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা !

দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী, মানুষ কিংবা পুরুষের কাছ থেকে সীমাহীন বিশ্বাসভঙের বেদনা নিয়ে জীবনের সব নির্মমতা নিজ শরীরে ধারণ করে যে মেয়েটি চিরতরে চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তার জন্য তুলে রাখি কান্নাকাতর কয়েকটা কালো অক্ষর-

কোন বিশ্বাসে বুক বাধি বলো?
কার হাতে রাখি হাত?

সকালে আমার হয়না সকাল

সন্ধ্যার পরে রাত

প্রহরীর কাছে বিশ্বাস মানে

শোষণের ধারাপাত!!

লেখক: রম্যলেখক