ভোট ভয়ঙ্কর

বাংলাদেশে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ চেহারা কেমন হবে? এটা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। যেকোনও গবেষণার জন্য তথ্য উপাত্ত লাগে। যারা গবেষণা করেন তারা বর্তমানের ডাটা নিয়ে ভবিষ্যতের পথে হাঁটেন অতীতকে মাথায় নিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন। তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ দশম সংসদ নির্বাচন, পরবর্তীতে পৌরসভা নির্বাচন ও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুবই সাফল্যের (!) সঙ্গে সম্পন্ন করে ক্ষমতাবান কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীদের বিজয় লাভে সহযোগিতা করে সাফল্যের ঢেকুর তুলেই এবার ইউপি নির্বাচনে হাত দিয়েছেন।
বলা বাহুল্য, এবারের ইউপি নির্বাচনের একটা বড় মাজেজা আছে। এটা এই নির্বাচন কমিশনের সৌভাগ্য যে তাদের হাতেই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছে। এবং এবারই এই নির্বাচন বহু ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২২ মার্চ ২০১৬ প্রথম ধাপের নির্বাচন দেখেই বোঝা গেছে এবারের নির্বাচন কেমন হবে। ৩১ মার্চ দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শেষ  হলো। সর্বশেষ খবর হচ্ছে এ ধাপে এখন পর্যন্ত শিশু, নারীসহ ৮ জন নিহত হয়েছে নির্বাচনি সহিংসতায়। এবারের নির্বাচনের সহিংসতার বড় ঘটনা ঘটছে সরকারি দলের প্রার্থীদের মধ্যেই। এইসব দলবাজ সংঘর্ষ ঠেকাতে পুলিশের গুলিতেও প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। প্রথম দফা নির্বাচনে মঠবাড়িয়ার এক সেন্টারে ক্ষমতাবানদের পক্ষের মানুষের ভোট ঠেকাতে বিজিবি-পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে মোট পাঁচজন। প্রথম দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিন (২২ মার্চ, ২০১৬) পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাফা ডিগ্রি কলেজের কেন্দ্রে নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ এবং ৫ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের ‘ট্রিগ্যারহ্যাপি’ নীতি বাধাহীনভাবে এগিয়ে চলেছে। পরবর্তীতে এ ঘটনায় ১৩০০ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
প্রথম দফার চাইতে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন আরও সহিংস হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য তা বলে না। তাদের ভাষ্যমতে ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের তুলনায় ৩১ মার্চের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সহিংসতা, জবরদস্তি ও প্রাণহানি কম হয়েছে। কেননা প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ১১ জন নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছিল। সে তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে প্রাণহানি তো মাত্র ৮ জনের!
যদিও একটি মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব মতে গত একমাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩৭ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ২ হাজারের বেশি মানুষ।
দুই.

প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ৫২২টি ইউনিয়ন পরিষদের ফলাফল বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, এর ৭৫% ইউপিতে জিতেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। প্রাপ্ত ভোটের ৩৪.০৩% পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ১০.৪৭% পেয়েছে বিএনপি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট ১০.৪৪%। ১.৪৬% ভোট পেয়েছে ইসলামি আন্দোলন। দ্বিতীয় দফার ফলাফল সরকারি দলের প্রতীক পাওয়া প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের (প্রতীক পাওয়া + বিদ্রোহী) বিজয় কেতন আরও বড় হয়েছে এবং সগৌরবে তা সবার সামনে প্রকাশিত হচ্ছে। আশা করা যায় নির্বাচনের ধাপ যত বাড়বে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ততই এসব অনায্য প্রবণতা বিশেষ করে , ‘জোর যার ভোট তার’ এই নীতিই জয়যুক্ত হবে। এই নির্বাচনে একটি কমন সূত্র প্রকাশ পেয়েছে। তা হলো নির্বাচনে জেতার জন্য জনগণের ভোটের চাইতেও মূল্যবান হচ্ছে সরকারি দলের নমিনেশন। ওটা নিশ্চিত হলেই কেল্লাফতে। অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটছে, দলের মনোনয়ন পেলেও কাজ হচ্ছে না, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। সেখানেও কাজ করছে শক্তির জোর।

তিন.

এই নির্বাচনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিবেচনা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা ও দক্ষতার মান। তার চাইতেও বড় কথা জোর জবরদস্তি আর সহিংসতার নির্বাচনকে কীভাবে দেখছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বা কী?

প্রথম ধাপের নির্বাচন শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পুরো ব্যবস্থাকে শতাংশের হারে দেখতে চেয়েছেন। মোট কেন্দ্র কত, তার কত শতাংশে গোলযোগ হলো। কত শতাংশ ভোট স্থগিত হলো- এই ফিল্টার দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিবেচনা হচ্ছে নির্বাচন ভালো হয়েছে।

১৬ কোটি বা ২০ কোটি লোকের দেশে মাত্র ১১ জন মারা গেলে এর শতাংশ ফিল্টার কী বলে? ১১ জন ১৬ কোটি মানুষের কত শতাংশ? এই ক্ষুদ্র অংশ তো অগ্রাহ্যই করা যায়! প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাবেক আমলা কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বিবেচনা হচ্ছে এই ‘শতাংশ মডেল’।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনকে তিনি বলেছেন সুষ্ঠু। কেননা, আগের ধাপের নির্বাচনে রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও দ্বিতীয় ধাপে তা ঘটেনি। দ্বিতীয় ধাপে জোর জবরদস্তি, হত্যা, খুন, গুলিবর্ষণ, অনিয়ম ঘটলেও যেহেতু আগেরদিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার ঘটনা উদঘাটিত হয়নি, ফলে দিনের বেলা জোর জবরদস্তি  কিংবা অনিয়ম যাই হোক না, রকিবউদ্দীন সাহেবের মতে এই নির্বাচন ‘ভালো নির্বাচন’ হিসেবে গণ্য করা জায়েজ। এই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সবচেয়ে রসিক মন্তব্য করেছেন ‘কালো বিড়াল কেলেঙ্কারি’ খ্যাত সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। হালে তিনি বলেছেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর নির্বাচন কমিশন। কমিশন ইচ্ছা করলে নির্বাচন বাতিলও করতে পারে, ইচ্ছা করলে গ্রহণও করতে পারে। যে কারও চাকরি খেতে পারে। কিন্তু এ কেমন কমিশন, লড়েও না চড়েও না। আগায়ও না পিছায়ও না।’

চার.

এই নির্বাচন ক্রমশ কতগুলো ভয়ঙ্কর এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশকে। কতগুলো সামাজিক-রাজনৈতিক ‘সন্ত্রাসী কৌশল’ রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে। এর ফলে একধরণের মাস্তানি সংস্কৃতির আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়া আমাদের রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যাপকতরভাবে জায়গা নিচ্ছে। এর নানারকম নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে-

এক. নির্বাচন ব্যবস্থার ওপরে মানুষের অনাস্থা তৃণমূল পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত হচ্ছে। নির্বাচনে সহিংসতা, জোরজবরদস্তি, শক্তি প্রয়োগ, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা নির্বাচন ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে তাতে সবক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার যে ঘাটতি বাংলাদেশে সুশাসনকে তিরোহিত করছে বলে চারপাশে হৈ-চৈ হচ্ছে, এই ঘটনা তাতে নতুন নতুন পালক যোগ করছে।

দুই. ‘জোর যার মুল্লুক তার’- এই প্রথা বর্বর মধ্যযুগীয় এবং সব অর্থেই সুশাসনবিরোধী। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই মধ্যযুগীয় নীতি ফিরে আসছে।

তিন. নির্বাচনে জেতার জন্য এখন জনভোট আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকারি দলের প্রতীকই যথেষ্ট। ফলে গায়ের শক্তিতে প্রশাসনের জোরে, দলীয় প্রতীকের ভারে যারা নির্বাচিত হচ্ছে জনভোট ছাড়া, জেতার পর জনগণের কাছে তাদের আর কোনও দায়ভার থাকছে না। জনগণকে তারা থোড়াই দেয়ার করবেন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তৃণমূলে এই বিবেচনা পুরো শাসন কাঠামোকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থির করে তুলতে পারে।

চার. বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে বিভাজন রাজনীতির পুরনো রীতি। কিন্তু দলের মধ্যে বিশেষত সরকারি দলের মধ্যে সহিংস বিভাজনের এই নতুন কায়দা সরকারি দলের তৃণমূল কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এবারের ইউপি নির্বাচন তৃণমূলের রাজনীতিতে শক্তিনির্ভর যে পরিবর্তন আনছে তা যে কোনও বিপদের দিনে রাজনৈতিক দলগুলোকে গভীরতর বিপদে ঠেলে দিতে পারে।

আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হতো উৎসবের আমেজে। এই নির্বাচন গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সমাজে আনন্দজাগানিয়া ঢেউ তুলতো । এবারে ঘটছে উল্টো ঘটনা। সহিংসতা, প্রাণহানি আর ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি এমন আবহ তৈরি করেছে এবারের নির্বাচন ক্রমশ ভোট আনন্দ থেকে ভোট দুঃখে পরিণত হতে চলেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা ও অক্ষমতা সেই ভয়াল দুঃখ দিনকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক